আমি একজন তরুণীকে চিনি, যার ব্যাগে সর্বক্ষণ থাকে একখণ্ড রুমি। ব্যাগে মেকআপ-টাকাপয়সা তুলতে ভুলে গেলেও রুমিকে তুলতে ভোলেন না তিনি। রূপবতী এই তরুণী ফেসবুকে-ইনস্টাগ্রামে প্রায় প্রায়ই নিজস্বী ছাপেন- ক্যাপশনে থাকে রুমি থেকে উদ্ধৃতি।
একালের একজন নবীন পপ শিল্পীকে চিনি, যার ফেসবুক প্রোফাইলে ডেসক্রিপশন সেকশানে ইংরেজিতে লেখা - ‘হোয়াট ইউ আর সিকিং ইজ সিকিং ইউ- রুমি’। বাংলায় মানে দাঁড়ায়- আপনি যা খুঁজছেন তা আপনাকেও খুঁজছে।
আমার দেখা অসংখ্য রুমিপ্রেমী, যারা এ যুগের মানুষ, তাদের মধ্যে মাত্র দুটি উদাহরণ দিলাম। দুনিয়াজুড়ে জালালুদ্দিন রুমির ভক্তের সংখ্যা যে অগণিত- সেকথা বলাই বাহুল্য।
তার হৃদয়গ্রাহী রুবাইয়ের বই বেশ অনেক বছর ধরে লাখ লাখ কপি বিক্রি হয় আমেরিকায়। রুমির যেকোনো অনুবাদ আমেরিকায় বেস্ট সেলারের তালিকায় থাকে।
আপনি যদি কোনও আমেরিকানের কাছে দেশটির সবচাইতে জনপ্রিয় কবির নাম জানতে চান, উত্তর আসতে পারে- জালালুদ্দিন রুমি। ফারসি ভাষার একজন কবি, সাধক ও সুফি গুরু- যিনি আমেরিকান হওয়াতো দূরের কথা, কোনোদিন আমেরিকায় যানইনি- যার জন্ম হয়েছে ৮০৭ বছর আগে তাজিকিস্তানের একটি ছোট্ট গ্রামে। তিনিই আমেরিকার বেস্ট সেলার কবিদের একজন।
ব্রাড গুচ লিখছেন রুমির জীবনী। তিনি ফ্রাঙ্ক ও’হারা এবং ফ্ল্যানারি ও’কনরের জীবনী লিখে প্রশংসিত হয়েছেন আগেই।
২০১৪ সালে বিবিসির ফিচার করেসপন্ডেন্ট জেইন চাবাটারিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন গুচ। সেখানে তিনি বলেন, রুমি “সব সংস্কৃতিতেই আকর্ষণীয় এক চরিত্র।”
বিরাট পৃথিবীর মোটে আড়াই হাজার মাইলজুড়ে বিচরণ ছিল রুমির। কবি জীবদ্দশায় যেখানে যেখানে গেছেন, থেকেছেন- তার প্রতিটি জায়গায় ভ্রমণ করেছেন ব্রাড গুচ।
তাজিকিস্তানের যে ছোট্ট গ্রামটিতে ১২০৭ খ্রিষ্টাব্দে রুমির জন্ম হয়েছিল, সেই ভাকশ গেছেন তিনি। সেখান থেকে উজবেকিস্তানের সমরখন্দ,তারপর ইরান হয়ে সিরিয়া। এমনকি কৈশোরত্তর রুমি সেসব জায়গায় বিদ্যার্জন করেছেন- সেই দামেস্ক এবং আলেপ্পোতেও গিয়েছেন গুচ।
রুমির শেষ গন্তব্য ছিল কোনিয়া। তুরস্কের এই শহরটিতেই জীবনের শেষ ৫০ বছর কাটিয়েছেন রুমি।
আজও প্রতি বছর ১৭ই ডিসেম্বর এলে জালালুদ্দিন রুমির সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে হুমড়ি খেয়ে পড়েন তার ভক্তরা, এমনকি রাষ্ট্রপ্রধানেরাও।

শামস তাবরিজি কি রুমির প্রেমিক?
১২৪৪ সাল। এই বছরটিতেই রুমির জীবনের সবচাইতে বড় বাঁকবদল হয়। এ বছরই রুমির জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের সাথে সাক্ষাৎ হয়। একজন ভবঘুরে মানুষ। নাম তার শামস তাবরিজি।
সাঁইত্রিশ বছরের রুমি তখন একজন গতানুগতিক সেকেলে ধর্মপ্রচারক। তার বাপদাদাও করে গেছেন একই কাজ।
“তিন বছর ধরে অন্যরকম এক বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে দুজনের মধ্যে। তাদের সম্পর্ক কি প্রেমিক ও প্রিয়র? নাকি গুরু ও শিষ্যের- সেটা কখনো স্পষ্ট হয়নি,” ২০১৪ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ব্রাড গুচ।
শামস তাবরিজির সাথে সম্পর্ক যাই হোক, সেই সম্পর্কই রুমিকে এক গভীর সাধক হবার পথে নিয়ে গিয়েছিল।
তিন বছর পর শামস হঠাৎ উধাও হয়ে যান।
“হয়ত রুমির ঈর্ষান্বিত কোন পুত্রের হাতে নিহত হয়েছিলেন। কিংবা (তাবরিজি) নিজেই সরে গিয়েছিলেন, যাতে রুমি বিচ্ছেদের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারেন”, বলেন গুচ।
বিরহী রুমি তখন কবিতার আশ্রয় নেন।
আমরা যে কবিতা পাই, তার অধিকাংশই ৩৭ থেকে ৬৭ বছর বয়সের মধ্যে লেখেন রুমি।
তিনি শামস তাবরিজি, হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এবং আল্লাহর উদ্দেশে তিন সহস্রাধিক প্রেমগীতি লিখেছেন, বলেন গুচ।
রুমি আরও লিখেছেন দুই সহস্রাধিক রুবাই- চার লাইনের ছোট কবিতা। আর লিখেছেন যুগল পংক্তিতে ছয় খণ্ডের এক আধ্যাত্মিক মহাকাব্য- ’মসনবি’।
লেখার মাধ্যমে শামস তাবরিজির প্রতি রুমির যে নিবেদন, সেটা যদি প্রেম হয়, সেই কারণে রুমির ঈর্ষাকাতর পুত্র যদি তাবরিজিকে খুন করে- সেটা কি রুমির সমকামী চরিত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে? তবে কি রুমি সমকামী ছিলেন?
২০১৪ সালে আমেরিকায় কলোরাডো অঙ্গরাজ্যের নারোপা ইউনিভার্সিটির কবিতার অধ্যাপক ছিলেন অ্যান ওয়াল্ডম্যান।
বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ‘জ্যাক ক্যারুয়াক স্কুল অব ডিজএমবডিড পোয়েটিক্স’ বিভাগের একজন সহপ্রতিষ্ঠাতাও তিনি। আরেকজন সহপ্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ।
এই অ্যান ওয়াল্ডম্যানের বর্ণনায় জানা যায়, রুমির সমলিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ ছিল। তাবরিজিকে লেখা তার অসংখ্য পঙ্ক্তিতে তার প্রকাশ পাওয়া গেছে, বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ওয়াল্ডম্যান।
অ্যান ওয়াল্ডম্যান বলছেন, রুমি সমলিঙ্গের সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয়েছিলেন কি হননি, সেটা তর্কসাপেক্ষ হতে পারে, তবে তিনি একজন সমকামী মানসিকতার মানুষ ছিলেন।
আর ব্রাড গুচের চোখে রুমি ছিলেন, “আনন্দ ও ভালোবাসার কবি।”
“শামসের কাছ থেকে বিচ্ছেদ এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই তার কবিতা জন্ম নেয়।”
অন্তর্দৃষ্টির চোখ
রুমি তার কবিতা, সংগীত ও নৃত্যকে এক সময়ে মেডিটেশন চর্চার পর্যায়ে নিয়ে যান।
“তিনি ধ্যান করতে করতে কিংবা কবিতার ডিকটেশন দিতে দিতে ঘুরে ঘুরে নাচতেন,” বলেন গুচ। “তার মৃত্যুর পর সেটিই পরিণত হয় পরিমার্জিত ধ্যাননৃত্যে।”
রুমি নিজেই লিখেছেন, “আগে আমি প্রার্থনা করতাম। এখন আমি গান, ছড়া আর কবিতা আবৃত্তি করি।”
রুমির মৃত্যুর কয়েক শতাব্দী পরও তার কবিতা ও পঙ্ক্তি আবৃত্তি করা হচ্ছে, সংগীত হচ্ছে, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, ইউটিউব ভিডিও, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় উদ্ধৃতি হয়ে উঠছে, যার প্রমাণ আমি এই লেখার শুরুতেই দুটি উদাহরণের মাধ্যমে দিয়েছি।

প্রশ্ন হলো- কেন রুমি আজও প্রাসঙ্গিক?
“তার ভাষা একেবারে অন্তঃস্থলে পৌঁছে যায়।” এমনকি একবার একটি গাড়িতে সাঁটা স্টিকারে রুমির লাইন থেকে উদ্ধৃতি দেখেছিলেন ব্রাড গুচ। সেখানে লেখা, “ভালো ও মন্দের ধারণার বাইরেও একটি জগৎ আছে, সেখানে আমি তোমার সঙ্গে দেখা করব।”
বি অ্যান ওয়াল্ডম্যান বলেন, “রুমি আমাদের সময়ের জন্য এক রহস্যময় ও অনুপ্রেরণাদায়ী কবি। সুফি ঐতিহ্য, উন্মাদনা ও ভক্তির প্রকৃতি এবং কবিতার শক্তি বোঝাতে তিনি অনন্য।”
পোয়েটস হাউসের নির্বাহী পরিচালক লি ব্রিচেত্তি বলেন, “স্থান, কাল ও সংস্কৃতি পেরিয়ে রুমির কবিতা জীবনের অনুভূতি প্রকাশ করে।”
তিনি রুমির কাজের তুলনা করেন শেক্সপিয়রের সঙ্গে- তার “গভীর অনুরণন ও সৌন্দর্যের” কারণে।
আমেরিকায় গত শতকের শেষভাগ থেকে রুমির যে পুনর্জাগরণ হয়েছে তার পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে অনুবাদক কোলম্যান বার্কসের।
তার চোখে “বিস্ময়কর সতেজ কল্পনাশক্তি, গভীর আকুলতা, রসবোধ এবং কৌতুকমিশ্রিত প্রজ্ঞা” আমেরিকায় রুমিকে বেস্ট সেলারে পরিণত করেছে।
কবি রবার্ট ব্লাই ১৯৭৬ সালে বার্কসের হাতে রুমির অনুবাদের একটি কপি তুলে দিয়ে বলেছিলেন, “এই কবিতাগুলোকে খাঁচা থেকে মুক্ত করতে হবে।”
বার্কস সেগুলোকে কঠিন অ্যাকাডেমিক অনুবাদ থেকে সহজ-সরল আমেরিকান ছন্দে রূপান্তর করেছিলেন।
এরপর ৩৩ বছরে তার অনুবাদে ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী এসব অনুবাদের কুড়ি লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়েছে। বার্কসের ইংরেজি অনুবাদ থেকে আরো তেইশটি ভাষায় হয়েছে রুমির রচনার রূপান্তর।
সময়ের চেয়ে ৮০০ বছর এগিয়ে
বার্কস বলেন, “আমি অনুভব করি, এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় বিভাজন ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা অবসান করবার একটা প্রবল আকাঙ্ক্ষা আছে, একটা শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে উঠছে।”
ধারণা করা হয়, ১২৭৩ সালে রুমির জানাজায় সব ধর্মের মানুষ অংশ নিয়েছিলেন।
“কারণ, তাদের চোখে, রুমি তাদের নিজ নিজ বিশ্বাসকে আরো গভীর করে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছেন। এখনকার যে আবেদন, তাতে এটা এখন আরো শক্তিশালী একটা উপাদান,” বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রুমি অনুবাদক কোলম্যান বার্কস।
“পারস্যের কবিদের মধ্যে রুমিই ছিলেন একমাত্র গবেষণাধর্মী এবং একইসঙ্গে একজন সুফি গুরু। এই দুইয়ের মিশেলই তার আজকের জনপ্রিয়তার মূল কারণ," বলেন বার্কস।
জাভিদ মোজাদ্দেদি একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত রুমি অনুবাদক। তিনি বলেন, রুমির চারটি প্রধান উদ্ভাবনের মধ্যে প্রথমটি হল তিনি পাঠকদের উদ্দেশ্যে সরাসরি কথা বলতেন; অর্থাৎ ‘তুমি’, ‘তোমরা’ বা ‘তোমাদের’ বলে সম্বোধন করতেন পাঠককে।
“আমি মনে করি এখনকার পাঠকেরা এভাবে সরাসরি কথা বললেই ভালো সাড়া দেন”, বলেনি জাভিদ মোজাদ্দেদি।
বাদবাকি উদ্ভাবনী উপাদানগুলো ছিল শিক্ষা দেয়ার আগ্রহ, দৈনন্দিন চিত্রকল্প ব্যবহার আর কবিতায় মিলনাত্মক প্রেম। রুমির প্রেমের পংক্তিগুলো আশার বাণী শোনায়। নৈরাশ্যের স্থান নেই সেখানে।
আরও পড়ুন: ইতিহাস সুবিচার করেনি: শেক্সপিয়ারের স্ত্রী ও ছেলেকে ঘিরে ৪০০ বছরের রহস্য
রুমির মহাকাব্য ‘মসনবি’ প্রায় ছাব্বিশ হাজার পংক্তির একটি বিশাল আধ্যাত্মিক রচনা, যা “পবিত্র কোরআন শরীফের পর মুসলিমবিশ্বে তর্কসাপেক্ষে সবচাইতে প্রভাবশালী গ্রন্থগুলোর একটি বলে মনে করা হয়”, বলেন জাভিদ মোজাদ্দেদি।
অটোমানরা যখন ইউরোপ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তখন সেখানে অনেক ইনস্টিটিউটেই রুমির মূল ফারসি রচনা নিয়ে এন্তার গবেষণা হয়েছে।
এখন যেহেতু নতুন নতুন অনুবাদ বের হচ্ছে এবং তার কাজ এখনো যেহেতু প্রাসঙ্গিক রয়েছে- তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে রুমির প্রভাব সহসাই শেষ হয়ে যাচ্ছে না পৃথিবীবাসীর কাছে।
জালালুদ্দিন রুমির প্রেরণাদায় পংক্তিগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেবে- কবিতা কীভাবে আমাদের প্রতিদিনের যাপিত জীবনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে।
নিচের ভিডিওতে দেখুন: লালনের গানের খাতা কেন নিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর?



