ধৈর্য্য ধারণ করুন, হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না: প্রফেসর ইউনূস

সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে মৃত্যু হয় ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা ৮ আসনের এমপি প্রার্থী শরীফ ওসমান বিন হাদির। শুক্রবার তার মৃতদেহ ঢাকায় আনা হবে। বাংলাদেশে শনিবার রাষ্ট্রীয় শোক।

আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:২১ এএম

শরীফ ওসমান বিন হাদির মৃত্যুর পর ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাত নাগাদ বহু মানুষ মিছিল যোগে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়েছেন।

চট্টগ্রামে ভারতের সহকারী হাই কমিশনারে বাসভবনের দিকেও বিক্ষুব্ধ মানুষেরা মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল বলে একটি টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে। চট্টগ্রামে বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ মিছিল হচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে সবাইকে ধৈর্য্য ও সংযম বজায় রাখার এবং কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।

ওসমান হাদি যে প্লাটফর্মের মুখপাত্র ছিলেন সেই ইনকিলাব মঞ্চ হাদির উপর হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবিতে আগে থেকেই শাহবাগে অবস্থান নিয়েছিল। তারা ঘোষণা দিয়েছিল হামলাকারী গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান নেবে।

বৃহস্পতিবার রাত পৌনে দশটার দিকে ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর আসার পর ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

টেলিভিশনগুলোতে প্রচারিত লাইভ ভিডিওতে দেখা যায় খণ্ড খণ্ড মিছিলে মানুষকে শ্লোগান দিতে দিতে শাহবাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

অনেকের হাতেই ছিল হাদিকে নিয়ে প্ল্যাকার্ড।

বৃহস্পতিবার রাত নাগাদ বহু মানুষ মিছিল যোগে ঢাকার শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয়েছেন।

শাহবাগে বিক্ষোভকারীদের দেখা যায় ছোট ছোট আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে।

তারা স্লোগান দিচ্ছিল, “দিল্লি না ঢাকা - ঢাকা, ঢাকা।”

আরও পড়ুন দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের অফিসে হামলা, অগ্নিসংযোগ

ওসমান হাদির সম্ভাব্য হামলাকারী ভারতে পালিয়ে গেছে এমন একটি ধারণা ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই কয়েকদিন ধরেই হাদির সমর্থকদের ভারতবিরোধী শ্লোগান দিতে দেখা গেছে।

এমনকি বুধবার ঢাকায় ভারতীয় ভিসা সেন্টার ঘেরাও করার একটি কর্মসূচি দেয়া হলো দুপুরের পরই ভিসা সেন্টারটি বন্ধ করে দেয়া হয়।

হাদির উপর হামলাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ভারতবিরোধী বক্তব্য আসার পর ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে নতুন করে কূটনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ

বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে এগারোটার দিকে স্বল্প সময়ের নোটিশে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস।

তিনি ওসমান হাদির মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বলেন ”ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদবিরোধী এই মহান সৈনিককে মহান আল্লাহ কবুল করুন এই দোয়া করি”।

“তার প্রয়াণ দেশের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি” উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা জানান, ওসমান হাদির স্ত্রী ও সন্তানের দায়িত্ব সরকার গ্রহন করবে।

 সবাইকে  ধৈর্য ও সংযম বজায় রাখার, অপপ্রচারে কান না দেয়ার এবং কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেয়ার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টা।

ওসমান হাদির মৃত্যুতে শনিবার একদিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশে। একই সাথে  শুক্রবার বাদ জুমা দেশের প্রতিটি মসজিদে বিশেষ দোয়ার আয়োজন করার কথাও বলা হয়। এছাড়া অন্যান্য ধর্মের উপসনালয়গুলোতে বিশেষ প্রার্থনা হবে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা।

প্রফেসর ইউনূস ওসমান হাদির বিশেষ পরিচর্যা ও খোঁজখবর রাখার জন্য সিঙ্গাপুরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. ভিভিয়ান বালাকৃষ্ণানকে ধন্যবাদ জানান।

হাদির হত্যার সাথে জড়িত  সকল অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনার এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধান উপদেষ্টা ।

“এ ব্যাপারে কোন শৈথিল্য দেখানো হবে না", বলেন প্রফেসর ইউনূস।

একই সাথে তিনি সবাইকে  ধৈর্য ও সংযম বজায় রাখার, অপপ্রচারে কান না দেয়ার এবং কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত না নেয়ার আহ্বান জানান।

গণসংযোগ করার সময় হামলার শিকার

গত ১২ই ডিসেম্বর একটি নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় হাদিকে লক্ষ্য করে একটি চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে গুলি করা হয়।

তার মাথার একপাশ থেকে গুলি লেগে অপর পাশ থেকে বেরিয়ে যায়।

ঢাকা মেডিকেলে প্রথম দফায় ও পরে এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয় তাকে। হাদির মাথায় এভারকেয়ার হাসপাতালে একটি অস্ত্রোপচারও করা হয়।

পরে সোমবার একটি এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে হাদিকে সিঙ্গাপুরে নেয়া হয়। সেখানে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে বৃহস্পতিবার একটি অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও এক পর্যায়ে হাদি জীবন মৃত্যুর সন্ধ্যিক্ষণে চলে যান হাদি।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন ওসমান হাদি এবং এরপর থেকেই ইনকিলাব মঞ্চ-এর মাধ্যমে রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে ওঠেন।

বাংলাদেশ সময় বৃহস্পতিবার রাত ৯:৪৫ মিনিটে হাদির মৃত্যু হয়।

শুক্রবার দুপুর নাগাদ হাদির মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে বলে খবরে জানা গেছে।

শরিফ ওসমান বিন হাদি ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা ছিলেন। তিনি ইনকিলাব মঞ্চ নামে একটি প্লাটফর্ম গড়ে তোলেন।

আগামী ১২ই ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় নির্বাচনে তিনি ঢাকা ৮ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলেও কথা ছিল। ১২ই ডিসেম্বর যখন গুলিবিদ্ধ হন তখনও তিনি নির্বাচনী এলাকায় গণসংযোগ চালাচ্ছিলেন।

হাদির মৃত্যুতে শোক জানিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ও প্লাটফর্ম থেকে বিবৃতি দেয়া হয়েছে।

শোক জানিয়েছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমীগর। জামায়াতে ইসলামের আমীর ডা. শফিকুর রহমানও এক আলাদা বিবৃতিতে শোক জানিয়েছেন।

কে হাদি?

ওসমান হাদি ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ নামে যুবকদের একটি প্ল্যাটফর্মের নেতা ও মুখপাত্র। ঝালকাঠিতে জন্ম নেয়া তরুণ এই রাজনৈতিক নেতা পড়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

শেখ হাসিনার সরকার পতনের জুলাই আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি এবং এরপর থেকেই ইনকিলাব মঞ্চ-এর মাধ্যমে রাজনীতিতে আলোচিত হয়ে ওঠেন।

দেশের রাজনৈতিক বিভিন্ন ইসুতে তিনি মন্তব্য করেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা ও ভারত নিয়ে ‘তীব্র সমালোচনা’ করতেন তিনি।

কেন তিনি টার্গেট?

হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তার বোন মাসুমা বেগম সাংবাদিকদের বলেছেন, “ভারত ওকে বাঁচতে দেবে না।”

যদিও মাসুমা বেগমের ওই মন্তব্য নিয়ে পুলিশ ও সরকারের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি। 

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ওসমান হাদি ঢাকা‑৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোট করার ঘোষণা দিয়েছেন। মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর নিয়ে গঠিত এই আসনটি রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়গুলো এই আসনের মধ্যে পড়েছে।

ভোটের প্রচারে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদি।

কয়েকটি গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, সম্প্রতি দেশি‑বিদেশি ৩০টি নম্বর থেকে হত্যার হুমকি পেয়েছেন হাদি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে হাদি কেন টার্গেট?

এই প্রশ্নের জবাব খুঁজেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক শুভ কিবরিয়া।

তিনি বলেন, “হাদি রাজনীতিতে খুবই ছোট পরিসরে, কিন্তু একটা নতুন ধারা চালু করেছেন। যেমন, তিনি ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে খরচ বহন করছেন। প্রতিদিন কত টাকা পেলেন, সেই হিসাব দিচ্ছিলেন।”

ওসমান হাদির রাজনৈতিক প্যাটার্ন, প্রতিষ্ঠিত প্যাটার্নগুলোর বাইরে একটি নতুন ধারা বলে মনে করেন শুভ কিবরিয়া।

“আবার সে এমন কোনো সংগঠিত লোক না, যার পেছনে প্রচুর লোক আছে। সুতরাং তাকে আঘাত করাটা সহজ। বড় একটা রাজনৈতিক দলের, বড় কাউকে আঘাত করাটা অনেক কঠিন।”

শুভ কিবরিয়া বলেন, “সুতরাং সে একটা পরিচিত মুখ, বিপ্লবের মুখ, অনেকের শত্রু। তাই তাকে আঘাত করার মধ্য দিয়ে আপনি একটা ঘটনা ঘটাতে পারবেন এবং সেই হিসাবে সে একটা টার্গেট।