১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে জামায়াতের ন্যারেটিভ, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও সত্য
'একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেনি, করেছে ভারতীয়রা'- এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নতুন করে জেগে উঠেছে চব্বিশে, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অনেককেই বলতে শোনা গেছে এমন কথা। কিন্তু ইতিহাসের নথিগুলো ঘেঁটে দেখলে কি এই তত্ত্বের সমর্থনকারী কোন দলিল পাওয়া যায়? নাকি আঙুল ওঠে পাকিস্তান ও তার দোসরদের দিকেই?
রাহী নায়াব
প্রকাশ : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:৫৫ পিএমআপডেট : ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৫০ পিএম
'একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেনি, করেছে ভারতীয়রা' - এই কথাটা আজকাল অনেককে বলতে শোনা যায়। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থনে যে যুক্তি শোনা যায় তা হলো আত্মসমর্পণের মাত্র দুই দিন আগে কীভাবে পাকিস্তানিদের ও তাদের দোসরদের পক্ষে সম্ভব হতে পারে আত্মরক্ষার কথা চিন্তা না করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা?
২০১০ সালের ১৪ই ডিসেম্বরে জামায়াত নেতা ও সাবেক ইসলামি ছাত্র সংঘ নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ভারতে গিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করাটাকে আত্মমর্যাদাহানিকর বলে মনে করেছিলেন, তারা দেশেই থেকে গিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব বুদ্ধিজীবী ভারতীয় তাঁবেদারি মেনে নেবে না, এমন আশঙ্কা থেকেই তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।”
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা হিসেবে ধরে নেয়া হয় ইসলামি ছাত্র সংঘ ও আল-বদর বাহিনীকেই।
এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নতুন করে জেগে উঠেছে চব্বিশে, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অনেককেই বলতে শোনা গেছে এমন কথা।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ২০২৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বরে বলেন, “যে পাকিস্তানিরা পরাজিত, তারা নিজের জীবন যেখানে রক্ষা করতে পারছে না, তাদের আত্মসমর্পণের অলরেডি সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। তারা একটা দেশ, একটা জাতির জন্য আর কী ক্ষতি করতে পারে, এটা একটা বিশ্লেষণের বিষয়। যাদের সাহায্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করেছি বলে আধিপত্যবাদী শক্তির সেবাদাসেরা জাতির কাছে গর্বিত হতে চায়।”
এ ধরনের বক্তব্য শুধু জামায়াত থেকে নয়, এসেছে প্রাতিষ্ঠানিক মহল থেকেও। চব্বিশের ১৪ই ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসির উদ্দিন বলেন, “১৯৭১-এ ১৪ই ডিসেম্বরের আগে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল। এরপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু সে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দেশবাসী আজও জানে না। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজও কোন সমাধান হয়নি। প্রশ্ন রয়ে গেছে এ হত্যাকাণ্ড আসলে কারা ঘটিয়েছিল। আঙুলটা চলে যায় ভারতীয়দের দিকে।”
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় অভিযুক্ত দলগুলোর বাইরেও যখন শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে এই বয়ান আসে, তখন এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করতে দেখা যায় বাংলাদেশের অনেককেই।
কিন্তু ইতিহাস আসলে কী বলছে? ইতিহাসের নথিগুলো ঘেঁটে দেখলে কি এই তত্ত্বের সমর্থনকারী কোন দলিল পাওয়া যায়, নাকি আঙুল ওঠে পাকিস্তান ও তার দোসরদের দিকেই?
১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বরের নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা বলা হয়। বর্ণনা দেয়া হয় ঢাকার বাইরের দিকে পাওয়া ডাক্তার, অধ্যাপক, লেখক ও শিক্ষকদের লাশের কথা। সবার হাত ছিল পেছনে বাঁধা, ক্ষতবিক্ষত শরীরে ছিল গুলি ও বেয়নেটের চিহ্ন।
সেখানে বলা হয়, “পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সমর্থকরা তাদের হত্যা করেছিল। রাজাকাররা তাদের জিম্মি করে রেখেছিল।”
সেই প্রতিবেদনে আরও বর্ণনা পাওয়া যায় কয়েকজন রাজাকার বাঙালিদের ধরে নিয়ে একটি কারখানায় আটকে রেখেছিল। পরে যুদ্ধে হেরে আটক হওয়ার পর তাদের মধ্যে দু’জন রাজাকার বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কথা স্বীকার করে। লাশ শনাক্ত করতে আসা ব্যক্তিদের ওপর একটি মসজিদের ভেতর থেকে রাজাকাররা গুলি ছুঁড়েছিল, এমন বর্ণনাও পাওয়া যায়।
দ্য টাইমসের ২৩এ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের প্রতিবেদনে পাওয়া যায়, “বর্তমানে এ কথা জানা, যে ১২ই ডিসেম্বর যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, একদল সিনিয়র পাক সামরিক অফিসার ও তাদের বেসামরিক সহযোগীরা রাষ্ট্রপতির বাসভবনে সম্মিলিত হয়। তারা ২৫০ জন ব্যক্তির নামের তালিকা করে যাদের গ্রেফতার করে হত্যা করা হবে। এদের মধ্যে ছিল ঢাকার পেশাদার সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিরা যারা গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও দেশে টিকে ছিল।”
“উগ্র ডানপন্থি মুসলিম ব্যক্তিরা সোমবার ও মঙ্গলবার তাদের আটক করে। আটককারীরা ‘আল-বদর রাজাকার’ নামক সংগঠনের অংশ ছিল। আত্মসমর্পণের আগের ঘণ্টাগুলোতেই ঢাকার প্রান্তে নিয়ে হত্যা করা হয় তাদের,” ১৯৭১ সালের ২৩এ ডিসেম্বর লিখেছে দ্য টাইমস।
গভর্নর হাউজের তালিকা ও রাও ফরমান আলির সাক্ষাৎকার
বঙ্গভবনে (তৎকালীন গভর্নর হাউজ) পাওয়া এই তালিকার কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসবিদরা বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার জন্য দায়ী করে জেনারেল রাও ফরমান আলিকে, কেননা তিনিই ছিলেন গভর্নরের উপদেষ্টা এবং ভারতীয়দের আক্রমণের মুখে গভর্নর পদত্যাগ করার পর ঢাকার দায়িত্ব তার উপরেই ছিল। এ নিয়ে খোদ রাও ফরমান আলির বক্তব্য পাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ।
মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৯৬ সালে ইসলামাবাদে একাডেমি অফ লেটারস-এর আয়োজিত সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে।
সেখানে তার সাক্ষাৎ হয় জেনারেল রাও ফরমান আলির ভাতিজার সাথে। সেই সূত্রে তিনি জেনারেল রাও ফরমান আলি এবং একইসাথে জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির সম্মতি নেন সাক্ষাৎকারের জন্য।
এর ভিত্তিতে পাকিস্তানিদের চোখে একাত্তরকে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়, যেখানে মহিউদ্দিন আহমেদের পাশাপাশি সাগ্রহে যোগদান করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। তাদের সহায়তা দেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এই প্রকল্পের বরাতে নেয়া পাকিস্তানিদের সাক্ষাৎকারগুলো সংকলিত আছে 'পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর' নামের বইয়ে।
রাও ফরমান আলিকে বুদ্ধিজীবীদের তালিকার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সে তালিকা তার লেখা নয় বরং তার সাথে দেখা করতে আসা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাকে কিছু নামের তালিকা দিয়েছিল, যারা 'পাকিস্তানবিরোধী' ছিল।
কথায় কথায় তার কাছে জানা যায় বিবিসির এক সাংবাদিকের কথা। রাও ফরমান আলিকে নিয়ে ভুল তথ্য সম্প্রচার করার অভিযোগে এই সাংবাদিককে তলব করা হয়। রাও ফরমান আলি ওই সাংবাদিককে বলেন যে এর কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে পারে।
ওই সাংবাদিক তখন রাও ফরমান আলিকে বলেন, তার প্রাণ বাঁচাতে, কেননা তিনি শুনেছেন অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। জেনারেল দাবি করেন, তিনি সেবারই প্রথম শুনেছিলেন যে বেসামরিক মানুষজনকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনীর জেলে রাখা হচ্ছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় এড়িয়ে যান রাও ফরমান আলী। তার দাবি, ১৩ই ডিসেম্বর গভর্নর আব্দুল মুতালিব মালিক পদত্যাগ করার পর তার কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল না। তিনি এর পুরো দায় দেন জেনারেল নিয়াজিকে। বলেন, ৯ই বা ১০ই ডিসেম্বরের দিকে জেনারেল শমসের তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন একসাথে জেনারেল নিয়াজির সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য।
পিলখানায় পৌঁছে তিনি দেখেন বেশকিছু কালো রঙের গাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো।
জেনারেল শমসেরকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এগুলো “কয়েকজনকে গ্রেফতার করার জন্য” রাখা হয়েছে। কাকে গ্রেফতার করা হবে এ ব্যাপারে তিনি পরিষ্কার ছিলেন না বলে দাবি করেন।
রাও ফরমান আলির ভাষ্যমতে, জেনারেল নিয়াজির সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি আপত্তি করেন। বলেন যে, এখন কাউকে গ্রেফতার করার সময় নয়, তবে নিয়াজি তার কথা শোনেননি।
‘নিয়াজিই রাজাকারদের সৃষ্টিকর্তা’
আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশে অবস্থিত সকল পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে সোপর্দ করা হয় ভারতীয় বাহিনীর কাছে। ভারতের জেনারেল ও আর ঠাকুর ডেকে পাঠান রাও ফরমান আলিকে; বলেন, “আপনার আদেশেই লোকগুলো প্রাণ হারিয়েছে”। “লোকগুলো” কারা, তা জিজ্ঞেস করলে রাও ফরমান আলি বলেন, “তারা সবাই ছিলেন বুদ্ধিজীবী”।
আল-বদর এবং আল-শামসের কথা জিজ্ঞেস করলে রাও ফরমান আলি বলেন, তিনি নয়, বরং ফোর্স কমান্ড্যান্ট নিয়াজিই তাদের আদেশকর্তা ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, “নিয়াজিই রাজাকারদের সৃষ্টিকর্তা, ব্যবহারকারী।”
জেনারেল রাও ফরমান আলি বুদ্ধিজীবী হত্যা ও তালিকার দায় সম্পূর্ণ এড়িয়ে নিজেকে 'একজন অসহায় ও অজ্ঞ ব্যক্তি' হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তার কথা থেকে এতটুকু পরিষ্কার হয় যে, যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে পাকিস্তানিরাই উদ্যোগ নিয়েছিল তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করার। তাছাড়া পরে রাও ফরমান আলির বাসভবনে পাওয়া তালিকার সাথে মিলে যায় শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের পরিচয়।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে, বুদ্ধিজীবী হত্যা শুধু ১৪ই ডিসেম্বর কিংবা ডিসেম্বরের পরিকল্পনা ছিল না, শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই রকম একটা পরিকল্পনা ছিল। অনেক বুদ্ধিজীবীকে শুরু থেকেই হত্যা করা হয়। তবে তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হবার পর।
‘জেনোসাইড’
অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের এই দাবিকে সমর্থন করার মতো নথিও পাওয়া যায় ইতিহাসে। সম্ভবত প্রথম নথি যেখানে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায় তা হলো অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ঐতিহাসিক প্রতিবেদন 'জেনোসাইড'।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি উদ্যোগে পাঠানো সাংবাদিক দলের সদস্য।
এই দলের কাজ ছিল এখানে এসে অবস্থা দেখে, কিছু ‘সাজানো ফুটেজ’ নিয়ে পাকিস্তানে ফেরত গিয়ে 'সব পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে' এমন ধারণা প্রচারে সাহায্য করা। বাকি সাংবাদিকরা অনুগতভাবে সেই নির্দেশ মেনেছিল, তবে মাসকারেনহাস এই দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা দেখে স্বাভাবিক থাকতে পারেননি। তার স্ত্রী ইভন মাসকারেনহাস বিবিসিকে পরে বলেন, “আমি তাকে কখনও এই অবস্থায় দেখিনি। সে বিস্মিত, হতভম্ব ও আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিল।”
মাসকারেনহাস তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, “আমি যা দেখে এসেছি তা যদি না লিখি, তাহলে কখনো আর কিছুই লিখতে পারব না।”
বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে মাসকারেনহাস চলে যান লন্ডনে, সোজা সানডে টাইমস-এর সম্পাদকের অফিসে। সম্পাদক তাকে আশ্বাস দেন, একবার তার পরিবারের বাকি সদস্যদের পাকিস্তান থেকে বের করতে পারলেই তিনি মাসকারেনহাস লেখা ছাপবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৩ই জুন সানডে টাইমসের প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয় 'জেনোসাইড' শিরোনামে মাসকারেনহাসের রিপোর্ট। প্রথমবারের মতো বিশ্ব জানতে পারে বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার কথা।
এই প্রতিবেদনে পাকিস্তানি অভিযানের বর্বরতার বিবরণের পাশাপাশি পাওয়া যায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রমাণ।
প্রথম অংশে তিনি লেখেন, “গণহত্যার শিকার শুধু পূর্ব বাংলার জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হিন্দু নন, সাথে আছে লাখ লাখ মুসলমানও। এর মধ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলের সদস্যরা।”
আরেক জায়গায় তিনি লেখেন, তালিকা ধরে বিশেষ ব্যক্তিদের খোঁজার কথা। “পঁচিশে মার্চ সেনাবাহিনী যখন ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে, অনেকের হাতেই এমন সব ব্যক্তির নামের তালিকা ছিল যাদের ‘নিষ্ক্রিয় করতে হবে’। এর মধ্যে ছিল হিন্দু শিক্ষার্থী ও বড় সংখ্যক মুসলমান শিক্ষার্থী, আওয়ামী লীগের সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও শেখ মুজিবের আন্দোলনের পক্ষের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।”
শিক্ষকদের হত্যা করে কিংবা নির্বাসিত করে পশ্চিম পাকিস্তানি শিক্ষকদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনার কথাও জানা যায় মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনে।
“সরকার কঠোরভাবে নেমে পড়েছিল পূর্ব বাংলার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর। এই স্থানগুলোকে ধরা হতো ষড়যন্ত্রের আঁতুড়ঘর, এবং এগুলোকে 'সর্ট আউট' করা হচ্ছিল। অনেক অধ্যাপক পালিয়ে গেছেন। বাকিদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের শীঘ্রই প্রতিস্থাপন করা হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারা।”
‘দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ দিয়ে ‘দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ’ নামে বই লেখেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ।
সেখানে এক জায়গায় লেখা হয়েছে, “যে বাঙালিরা দেশ থেকে পালাচ্ছিল, তারা প্রমাণসহ ব্যাখ্যা করছিল কীভাবে শত শত ডাক্তার, অধ্যাপক ও শিক্ষকদের রাতের আঁধারে গুম করে ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য সামরিক কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।”
আরেক জায়গায় তিনি বলেন, পাকিস্তানি অফিসারদের বিবরণ অনুযায়ী তাদের পাঁচটি প্রধান টার্গেট ছিল: ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা; হিন্দু জনগোষ্ঠী; আওয়ামী লীগের সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী; কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, শিক্ষক এবং এমন যেকোনো ব্যক্তি যাকে সেনাবাহিনী ‘জঙ্গি’ বলে বিবেচনা করবে।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বইতে এবং প্রতিবেদনেও এ কথা পরিষ্কার যে, পাকিস্তানিরা যুদ্ধের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করছিল ধাপে ধাপে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ধারণা অনুযায়ী ধরে নেয়া যায় যে এই পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপ ছিল ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।
ইতিহাস বিজয়ীরা লেখে, পরাজিতরা সেই ইতিহাসে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বিতর্ক সৃষ্টি করে। ইতিহাসের প্রচলিত বয়ানের সত্যতা নিয়ে বিতর্ক কোন নতুন জিনিস নয়। বরং বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, বিতর্ক হবে, এটিই গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য।
তবে সেই ইতিহাসের বয়ান বিশ্বাস করার সময় কিংবা কোন একটা বয়ানকে মেনে নিয়ে অন্য একটিকে খারিজ করার সময় আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে ঐতিহাসিক নথির।
ঐতিহাসিক নথি বলছে পাকিস্তানি সামরিক দখলদার বাহিনী ও তাদের বেসামরিক সহযোগীরাই হত্যা করেছিল এই মাটির সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের।
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে জামায়াতের ন্যারেটিভ, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও সত্য
'একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেনি, করেছে ভারতীয়রা'- এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নতুন করে জেগে উঠেছে চব্বিশে, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অনেককেই বলতে শোনা গেছে এমন কথা। কিন্তু ইতিহাসের নথিগুলো ঘেঁটে দেখলে কি এই তত্ত্বের সমর্থনকারী কোন দলিল পাওয়া যায়? নাকি আঙুল ওঠে পাকিস্তান ও তার দোসরদের দিকেই?
'একাত্তরে বুদ্ধিজীবীদের পাকিস্তানিরা হত্যা করেনি, করেছে ভারতীয়রা' - এই কথাটা আজকাল অনেককে বলতে শোনা যায়। এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থনে যে যুক্তি শোনা যায় তা হলো আত্মসমর্পণের মাত্র দুই দিন আগে কীভাবে পাকিস্তানিদের ও তাদের দোসরদের পক্ষে সম্ভব হতে পারে আত্মরক্ষার কথা চিন্তা না করে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা?
২০১০ সালের ১৪ই ডিসেম্বরে জামায়াত নেতা ও সাবেক ইসলামি ছাত্র সংঘ নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের সময় যেসব প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ভারতে গিয়ে দেশের জন্য যুদ্ধ করাটাকে আত্মমর্যাদাহানিকর বলে মনে করেছিলেন, তারা দেশেই থেকে গিয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এসব বুদ্ধিজীবী ভারতীয় তাঁবেদারি মেনে নেবে না, এমন আশঙ্কা থেকেই তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।”
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মূল হোতা হিসেবে ধরে নেয়া হয় ইসলামি ছাত্র সংঘ ও আল-বদর বাহিনীকেই।
এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব নতুন করে জেগে উঠেছে চব্বিশে, গণঅভ্যুত্থানের পর প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অনেককেই বলতে শোনা গেছে এমন কথা।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ২০২৪ সালের ১৪ই ডিসেম্বরে বলেন, “যে পাকিস্তানিরা পরাজিত, তারা নিজের জীবন যেখানে রক্ষা করতে পারছে না, তাদের আত্মসমর্পণের অলরেডি সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। তারা একটা দেশ, একটা জাতির জন্য আর কী ক্ষতি করতে পারে, এটা একটা বিশ্লেষণের বিষয়। যাদের সাহায্যে আমরা মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা অর্জন করেছি বলে আধিপত্যবাদী শক্তির সেবাদাসেরা জাতির কাছে গর্বিত হতে চায়।”
এ ধরনের বক্তব্য শুধু জামায়াত থেকে নয়, এসেছে প্রাতিষ্ঠানিক মহল থেকেও। চব্বিশের ১৪ই ডিসেম্বর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক নাসির উদ্দিন বলেন, “১৯৭১-এ ১৪ই ডিসেম্বরের আগে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বুদ্ধিজীবীদের চোখ বেঁধে তুলে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল। এরপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়, কিন্তু সে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দেশবাসী আজও জানে না। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে আজও কোন সমাধান হয়নি। প্রশ্ন রয়ে গেছে এ হত্যাকাণ্ড আসলে কারা ঘটিয়েছিল। আঙুলটা চলে যায় ভারতীয়দের দিকে।”
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় অভিযুক্ত দলগুলোর বাইরেও যখন শিক্ষাবিদদের কাছ থেকে এই বয়ান আসে, তখন এ ধরনের ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাস করতে দেখা যায় বাংলাদেশের অনেককেই।
কিন্তু ইতিহাস আসলে কী বলছে? ইতিহাসের নথিগুলো ঘেঁটে দেখলে কি এই তত্ত্বের সমর্থনকারী কোন দলিল পাওয়া যায়, নাকি আঙুল ওঠে পাকিস্তান ও তার দোসরদের দিকেই?
১৯৭১ সালের ১৮ই ডিসেম্বরের নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কথা বলা হয়। বর্ণনা দেয়া হয় ঢাকার বাইরের দিকে পাওয়া ডাক্তার, অধ্যাপক, লেখক ও শিক্ষকদের লাশের কথা। সবার হাত ছিল পেছনে বাঁধা, ক্ষতবিক্ষত শরীরে ছিল গুলি ও বেয়নেটের চিহ্ন।
সেখানে বলা হয়, “পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সমর্থকরা তাদের হত্যা করেছিল। রাজাকাররা তাদের জিম্মি করে রেখেছিল।”
সেই প্রতিবেদনে আরও বর্ণনা পাওয়া যায় কয়েকজন রাজাকার বাঙালিদের ধরে নিয়ে একটি কারখানায় আটকে রেখেছিল। পরে যুদ্ধে হেরে আটক হওয়ার পর তাদের মধ্যে দু’জন রাজাকার বুদ্ধিজীবীদের হত্যার কথা স্বীকার করে। লাশ শনাক্ত করতে আসা ব্যক্তিদের ওপর একটি মসজিদের ভেতর থেকে রাজাকাররা গুলি ছুঁড়েছিল, এমন বর্ণনাও পাওয়া যায়।
দ্য টাইমসের ২৩এ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের প্রতিবেদনে পাওয়া যায়, “বর্তমানে এ কথা জানা, যে ১২ই ডিসেম্বর যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, একদল সিনিয়র পাক সামরিক অফিসার ও তাদের বেসামরিক সহযোগীরা রাষ্ট্রপতির বাসভবনে সম্মিলিত হয়। তারা ২৫০ জন ব্যক্তির নামের তালিকা করে যাদের গ্রেফতার করে হত্যা করা হবে। এদের মধ্যে ছিল ঢাকার পেশাদার সমাজের শীর্ষ ব্যক্তিরা যারা গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরও দেশে টিকে ছিল।”
“উগ্র ডানপন্থি মুসলিম ব্যক্তিরা সোমবার ও মঙ্গলবার তাদের আটক করে। আটককারীরা ‘আল-বদর রাজাকার’ নামক সংগঠনের অংশ ছিল। আত্মসমর্পণের আগের ঘণ্টাগুলোতেই ঢাকার প্রান্তে নিয়ে হত্যা করা হয় তাদের,” ১৯৭১ সালের ২৩এ ডিসেম্বর লিখেছে দ্য টাইমস।
গভর্নর হাউজের তালিকা ও রাও ফরমান আলির সাক্ষাৎকার
বঙ্গভবনে (তৎকালীন গভর্নর হাউজ) পাওয়া এই তালিকার কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসবিদরা বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনার জন্য দায়ী করে জেনারেল রাও ফরমান আলিকে, কেননা তিনিই ছিলেন গভর্নরের উপদেষ্টা এবং ভারতীয়দের আক্রমণের মুখে গভর্নর পদত্যাগ করার পর ঢাকার দায়িত্ব তার উপরেই ছিল। এ নিয়ে খোদ রাও ফরমান আলির বক্তব্য পাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ।
মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৯৬ সালে ইসলামাবাদে একাডেমি অফ লেটারস-এর আয়োজিত সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে।
সেখানে তার সাক্ষাৎ হয় জেনারেল রাও ফরমান আলির ভাতিজার সাথে। সেই সূত্রে তিনি জেনারেল রাও ফরমান আলি এবং একইসাথে জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজির সম্মতি নেন সাক্ষাৎকারের জন্য।
এর ভিত্তিতে পাকিস্তানিদের চোখে একাত্তরকে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়, যেখানে মহিউদ্দিন আহমেদের পাশাপাশি সাগ্রহে যোগদান করেন অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী। তাদের সহায়তা দেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান। এই প্রকল্পের বরাতে নেয়া পাকিস্তানিদের সাক্ষাৎকারগুলো সংকলিত আছে 'পাকিস্তানীদের দৃষ্টিতে একাত্তর' নামের বইয়ে।
রাও ফরমান আলিকে বুদ্ধিজীবীদের তালিকার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সে তালিকা তার লেখা নয় বরং তার সাথে দেখা করতে আসা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা তাকে কিছু নামের তালিকা দিয়েছিল, যারা 'পাকিস্তানবিরোধী' ছিল।
কথায় কথায় তার কাছে জানা যায় বিবিসির এক সাংবাদিকের কথা। রাও ফরমান আলিকে নিয়ে ভুল তথ্য সম্প্রচার করার অভিযোগে এই সাংবাদিককে তলব করা হয়। রাও ফরমান আলি ওই সাংবাদিককে বলেন যে এর কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তার বিরুদ্ধে অ্যাকশন নিতে পারে।
ওই সাংবাদিক তখন রাও ফরমান আলিকে বলেন, তার প্রাণ বাঁচাতে, কেননা তিনি শুনেছেন অনেককে গ্রেফতার করা হচ্ছে। জেনারেল দাবি করেন, তিনি সেবারই প্রথম শুনেছিলেন যে বেসামরিক মানুষজনকে গ্রেফতার করে সেনাবাহিনীর জেলে রাখা হচ্ছে।
বুদ্ধিজীবী হত্যার দায় এড়িয়ে যান রাও ফরমান আলী। তার দাবি, ১৩ই ডিসেম্বর গভর্নর আব্দুল মুতালিব মালিক পদত্যাগ করার পর তার কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল না। তিনি এর পুরো দায় দেন জেনারেল নিয়াজিকে। বলেন, ৯ই বা ১০ই ডিসেম্বরের দিকে জেনারেল শমসের তাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন একসাথে জেনারেল নিয়াজির সাথে দেখা করতে যাওয়ার জন্য।
পিলখানায় পৌঁছে তিনি দেখেন বেশকিছু কালো রঙের গাড়ি সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো।
জেনারেল শমসেরকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, এগুলো “কয়েকজনকে গ্রেফতার করার জন্য” রাখা হয়েছে। কাকে গ্রেফতার করা হবে এ ব্যাপারে তিনি পরিষ্কার ছিলেন না বলে দাবি করেন।
রাও ফরমান আলির ভাষ্যমতে, জেনারেল নিয়াজির সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি আপত্তি করেন। বলেন যে, এখন কাউকে গ্রেফতার করার সময় নয়, তবে নিয়াজি তার কথা শোনেননি।
‘নিয়াজিই রাজাকারদের সৃষ্টিকর্তা’
আত্মসমর্পণের পর বাংলাদেশে অবস্থিত সকল পাকিস্তানি অফিসার ও সৈন্যকে সোপর্দ করা হয় ভারতীয় বাহিনীর কাছে। ভারতের জেনারেল ও আর ঠাকুর ডেকে পাঠান রাও ফরমান আলিকে; বলেন, “আপনার আদেশেই লোকগুলো প্রাণ হারিয়েছে”। “লোকগুলো” কারা, তা জিজ্ঞেস করলে রাও ফরমান আলি বলেন, “তারা সবাই ছিলেন বুদ্ধিজীবী”।
আল-বদর এবং আল-শামসের কথা জিজ্ঞেস করলে রাও ফরমান আলি বলেন, তিনি নয়, বরং ফোর্স কমান্ড্যান্ট নিয়াজিই তাদের আদেশকর্তা ছিলেন। তার ভাষ্যমতে, “নিয়াজিই রাজাকারদের সৃষ্টিকর্তা, ব্যবহারকারী।”
জেনারেল রাও ফরমান আলি বুদ্ধিজীবী হত্যা ও তালিকার দায় সম্পূর্ণ এড়িয়ে নিজেকে 'একজন অসহায় ও অজ্ঞ ব্যক্তি' হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তার কথা থেকে এতটুকু পরিষ্কার হয় যে, যুদ্ধের শেষ দিনগুলোতে পাকিস্তানিরাই উদ্যোগ নিয়েছিল তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করার। তাছাড়া পরে রাও ফরমান আলির বাসভবনে পাওয়া তালিকার সাথে মিলে যায় শহীদ হওয়া বুদ্ধিজীবীদের পরিচয়।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের মতে, বুদ্ধিজীবী হত্যা শুধু ১৪ই ডিসেম্বর কিংবা ডিসেম্বরের পরিকল্পনা ছিল না, শুরু থেকেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই রকম একটা পরিকল্পনা ছিল। অনেক বুদ্ধিজীবীকে শুরু থেকেই হত্যা করা হয়। তবে তা চূড়ান্ত রূপ নেয় ডিসেম্বরে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত হবার পর।
‘জেনোসাইড’
অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের এই দাবিকে সমর্থন করার মতো নথিও পাওয়া যায় ইতিহাসে। সম্ভবত প্রথম নথি যেখানে গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে হত্যার প্রমাণ পাওয়া যায় তা হলো অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের ঐতিহাসিক প্রতিবেদন 'জেনোসাইড'।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি উদ্যোগে পাঠানো সাংবাদিক দলের সদস্য।
এই দলের কাজ ছিল এখানে এসে অবস্থা দেখে, কিছু ‘সাজানো ফুটেজ’ নিয়ে পাকিস্তানে ফেরত গিয়ে 'সব পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে' এমন ধারণা প্রচারে সাহায্য করা। বাকি সাংবাদিকরা অনুগতভাবে সেই নির্দেশ মেনেছিল, তবে মাসকারেনহাস এই দেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা দেখে স্বাভাবিক থাকতে পারেননি। তার স্ত্রী ইভন মাসকারেনহাস বিবিসিকে পরে বলেন, “আমি তাকে কখনও এই অবস্থায় দেখিনি। সে বিস্মিত, হতভম্ব ও আবেগপ্রবণ হয়ে গিয়েছিল।”
মাসকারেনহাস তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, “আমি যা দেখে এসেছি তা যদি না লিখি, তাহলে কখনো আর কিছুই লিখতে পারব না।”
বিবেকের ডাকে সাড়া দিয়ে মাসকারেনহাস চলে যান লন্ডনে, সোজা সানডে টাইমস-এর সম্পাদকের অফিসে। সম্পাদক তাকে আশ্বাস দেন, একবার তার পরিবারের বাকি সদস্যদের পাকিস্তান থেকে বের করতে পারলেই তিনি মাসকারেনহাস লেখা ছাপবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন।
১৯৭১ সালের ১৩ই জুন সানডে টাইমসের প্রথম পাতায় বড় করে ছাপা হয় 'জেনোসাইড' শিরোনামে মাসকারেনহাসের রিপোর্ট। প্রথমবারের মতো বিশ্ব জানতে পারে বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার কথা।
এই প্রতিবেদনে পাকিস্তানি অভিযানের বর্বরতার বিবরণের পাশাপাশি পাওয়া যায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রমাণ।
প্রথম অংশে তিনি লেখেন, “গণহত্যার শিকার শুধু পূর্ব বাংলার জনসংখ্যার ১০ শতাংশ হিন্দু নন, সাথে আছে লাখ লাখ মুসলমানও। এর মধ্যে আছে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী দলের সদস্যরা।”
আরেক জায়গায় তিনি লেখেন, তালিকা ধরে বিশেষ ব্যক্তিদের খোঁজার কথা। “পঁচিশে মার্চ সেনাবাহিনী যখন ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে, অনেকের হাতেই এমন সব ব্যক্তির নামের তালিকা ছিল যাদের ‘নিষ্ক্রিয় করতে হবে’। এর মধ্যে ছিল হিন্দু শিক্ষার্থী ও বড় সংখ্যক মুসলমান শিক্ষার্থী, আওয়ামী লীগের সদস্য, অধ্যাপক, সাংবাদিক ও শেখ মুজিবের আন্দোলনের পক্ষের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।”
শিক্ষকদের হত্যা করে কিংবা নির্বাসিত করে পশ্চিম পাকিস্তানি শিক্ষকদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করার পরিকল্পনার কথাও জানা যায় মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনে।
“সরকার কঠোরভাবে নেমে পড়েছিল পূর্ব বাংলার কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর। এই স্থানগুলোকে ধরা হতো ষড়যন্ত্রের আঁতুড়ঘর, এবং এগুলোকে 'সর্ট আউট' করা হচ্ছিল। অনেক অধ্যাপক পালিয়ে গেছেন। বাকিদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তাদের শীঘ্রই প্রতিস্থাপন করা হবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের দ্বারা।”
‘দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ দিয়ে ‘দ্য রেইপ অফ বাংলাদেশ’ নামে বই লেখেন অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ।
সেখানে এক জায়গায় লেখা হয়েছে, “যে বাঙালিরা দেশ থেকে পালাচ্ছিল, তারা প্রমাণসহ ব্যাখ্যা করছিল কীভাবে শত শত ডাক্তার, অধ্যাপক ও শিক্ষকদের রাতের আঁধারে গুম করে ‘জিজ্ঞাসাবাদের’ জন্য সামরিক কেন্দ্রগুলোতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।”
আরেক জায়গায় তিনি বলেন, পাকিস্তানি অফিসারদের বিবরণ অনুযায়ী তাদের পাঁচটি প্রধান টার্গেট ছিল: ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা; হিন্দু জনগোষ্ঠী; আওয়ামী লীগের সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মী; কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, শিক্ষক এবং এমন যেকোনো ব্যক্তি যাকে সেনাবাহিনী ‘জঙ্গি’ বলে বিবেচনা করবে।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের বইতে এবং প্রতিবেদনেও এ কথা পরিষ্কার যে, পাকিস্তানিরা যুদ্ধের শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করছিল ধাপে ধাপে। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ধারণা অনুযায়ী ধরে নেয়া যায় যে এই পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপ ছিল ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড।
ইতিহাস বিজয়ীরা লেখে, পরাজিতরা সেই ইতিহাসে তাদের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, বিতর্ক সৃষ্টি করে। ইতিহাসের প্রচলিত বয়ানের সত্যতা নিয়ে বিতর্ক কোন নতুন জিনিস নয়। বরং বিভিন্ন বিষয় ও ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, বিতর্ক হবে, এটিই গণতান্ত্রিক সমাজের বৈশিষ্ট্য।
তবে সেই ইতিহাসের বয়ান বিশ্বাস করার সময় কিংবা কোন একটা বয়ানকে মেনে নিয়ে অন্য একটিকে খারিজ করার সময় আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে ঐতিহাসিক নথির।
ঐতিহাসিক নথি বলছে পাকিস্তানি সামরিক দখলদার বাহিনী ও তাদের বেসামরিক সহযোগীরাই হত্যা করেছিল এই মাটির সবচেয়ে মেধাবী সন্তানদের।