মতামত

কথা চলুক...

আমরা মানুষের পক্ষে আছি, যেন আমাদের সন্তান বড় হয়ে গর্বের সাথে বলতে পারে তাদের পিতা-মাতারা সুবিধাবাদী নয়। লোভী নয়। তাদের পিতা-মাতারা সময় এবং সাধারণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল বুক চিতিয়ে।

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:০৩ পিএম

মানুষের ইতিহাস আর শোষণ-নিপীড়নের ইতিহাস প্রায় সমবয়সী। একদল মানুষ, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ওপর বিভিন্ন নামে শোষণ শাসন চাপিয়ে দিয়েছে। নিপীড়ন চালিয়েছে। 

দুনিয়াজুড়ে মানুষের ইতিহাস মানেই লড়াই, যুদ্ধ, হত্যা, দখল, জুলুম, বেঈমানি এবং দীর্ঘশ্বাসের গল্প।

এর অপর পৃষ্ঠায় সাধারণের গল্প। 

যা প্রতিরোধের। সংগ্রামের। জালিম উৎখাতের, গণতন্ত্রায়ণ, শিল্পায়ন, আর্ট সংস্কৃতিসহ একেবারেই সাধারণের গল্প। এসবের বেশিরভাগের জায়গা হয়েছে ইতিহাসের গলি-ঘুপচিতে।

এর মধ্যেও এমন কিছু সময়, কিছু মানুষ (বীরত্ব অর্থে), কিছু ঘটনা আছে যা ইতিহাসকেই গৌরবান্বিত করেছে। সাধারণকে পথ দেখিয়েছে। শাসকদের জন্য সীমারেখা টেনে দিতে চেষ্টা করেছে। যেমন- রেনেসাঁ, বলশেভিক আন্দোলন, রাশায় কমিউনিস্ট শাসনের পতন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, কিউবা বিপ্লব, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ইত্যাদি।

অনাদিকাল ধরে মানুষ লড়াই করেছে, কিন্তু কোনোকালেই রাষ্ট্র বা সমাজের ক্ষমতা সাধারণের হয়নি। ফলে ক্ষমতাকে সে দূর থেকে ডিল করেছে, সমীহের চোখে। যতক্ষণ পর্যন্ত শাসকরা জনতার দেয়া রেড লাইন অতিক্রম করেনি, সাধারণ ততক্ষণ নিরীহ জীবনযাপন করেছে। এবং ক্ষমতার সার্কিটের বাইরে থেকে।

সাধারণ মানুষ চায় নিরাপত্তা, নিশ্চয়তা, মর্যাদা, সর্বোপরি স্বাধীনভাবে কথা বলার অধিকার। সে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ন্যুনতম স্পেস চায়, আলাপ চায়, অভাব-অনটনেও স্বস্তি চায়।.....

শাসকদের আবার তা পছন্দ নয়। জনগণের যদি কথা বলতেই হয়, তা হতে হবে শাসকদের জন্য প্রশংসাসূচক। শাসকদের বয়ান। জনগণকে তারা কোনো স্পেস দিতে চায় না। রাষ্ট্র এখন মানুষের বেডরুমে ঢুকে গেছে নিরাপত্তার নামে। নানান সমস্যা জর্জরিত মানুষের জন্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান না করে শাসকরা আড়িপাতার যন্ত্র কিনছে জনগণের ওপর খবরদারি করতে... এবং তা জনগণের নামেই।

আধুনিক রাষ্ট্র এখন নিপীড়নের প্রতীক। এশিয়া, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকাসহ দুনিয়ার বহুদেশে মানুষ রাষ্ট্র মেরামতের লড়াই করছে। মানুষ অকাতরে জীবন দিচ্ছে। কিন্তু থেমে যাচ্ছে না। একদল গেলে অন্যদল এসে সেই শূন্যতা পূরণ করছে। এভাবেই মানুষের নতুন ইতিহাস নির্মিত হয়।

‘জনগণ রাষ্ট্রের মালিক, জনগণ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী’- বলা হলেও সে কখনো মালিকানা দাবি করে না। বরং জনতার নামে যারা শাসন করে তাদেরও নিজের মনে করে খুব কমই।  সাধারণ শুধু ন্যুনতম নিশ্চয়তা চায়। রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠান যে ফাংশন করে জনগণের পক্ষে সেটা বুঝতে চায় সীমার মধ্যে থেকেই। 

আর এখানেই সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। শাসক ও তাদের অলিগার্কদের অপকর্ম, অন্যায়ের উপাখ্যান জনগণের সামনে তুলে ধরে ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই সংবাদমাধ্যমের কাজ। সে কাজ কতটা হচ্ছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। আজকের এই সময়ে রাষ্ট্র এতটাই প্রভাব এবং দাপুটে যে, ক্ষমতা নামক দানবের সামনে প্রায় সব প্রতিষ্ঠান আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। প্রথাগত সংবাদমাধ্যম কোনরকম টিকে থাকার চেষ্টা করছে। যদি বিকল্প আছে মানুষের কাছে। এবং সম্ভাব্য সব বিকল্প মাধ্যমেও সরকার খবরদারির চেষ্টা করছে।  

বাংলাদেশও নানা এক্সপেরিমেন্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। স্থিতিশীলতা আসেনি। কিন্তু হবে এই আশায় মাটি কামড়ে পড়ে আছে আমার মতো অসংখ্য মানুষ। আমরা চেয়েছি মানুষ প্রাণ খুলে হাসুক, যা বলতে চায় বলুক (শুধুমাত্র সীমার মধ্যে থেকে), মানুষ ভাবুক, প্রেম করুক, তর্ক করুক, গান গাক, ধর্ম পালন করুক, যার যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে বাঁচুক। তার সমস্যা বা বক্তব্য নির্ভয়ে প্রকাশ করুক।

এ পথ বহু দূরের। লড়াইয়ের অনেক বাকি। কিন্তু এই লড়াইয়েরই মানুষ। আমরা মানুষের পক্ষে আছি, যেন আমাদের সন্তানরা বড় হয়ে গর্বের সাথে বলতে পারে তাদের পূর্বপুরুষ সুবিধাবাদী ছিল না। লোভী নয়। তাদের পিতা-মাতারা সময় এবং সাধারণের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল বুক চিতিয়ে।

মহান মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয়-রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সহাবস্থান, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা, জনগণের ক্ষমতায়নসহ একটি ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে আলাপ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।

এরপরও আমরা (বাংলাদেশ) বহুবার হেরেছি। কিন্তু ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমাদেরই কেউ সুবিধার জামা গায়ে অবৈধ ফসল গোলায় ভরেছে। আবার কেউ কেউ অনিশ্চয়তায় লড়তে লড়তে মরে গেছে কিন্তু মাথা নোয়ায়নি। কেউ নিজ স্বার্থে সমষ্টির স্বার্থ পকেটস্থ করেছে। কেউ সমষ্টির জন্য নিজ স্বাচ্ছন্দ্য জলাঞ্জলি দিয়েছে। কেউ কলম নিলামে তুলেছে, কেউ কলম বুক পকেটে যত্নে রেখেছে। এই দ্বন্দ্বই সমাজ, মানুষ এবং রাষ্ট্রকে বিকশিত হতে সাহায্য করে।

এভাবেই সময়, সমাজ, মানুষ এবং দেশ এগোয়। যদিও আমাদের দেশ কেবলই পেছাচ্ছে সামনে এগুনোর জন্য। সাংবাদিকতার অবস্থা অবশ্য আরো খারাপ। কঠিনতম সময় পার করছে এই পেশা এবং পেশার মানুষেরা। এরচে অনিশ্চয়তার আর কোনো পেশা দেশে আছে কি না জানি না!

এই অনিশ্চয়তা এড়াতে সাংবাদিকতাকে বিদায় বলেছিলাম বেশ ক'বছর আগে। কিন্তু সাংবাদিকতা আমাকে ছাড়ল কই! দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সহকর্মীরা অনুরোধ করলেন, ভাল সংবাদপত্র বা টিভি করতেই হবে। কিন্তু আমার যে মন উঠে গেছে, কোনোভাবেই প্রথাগত মিডিয়ায় আগ্রহী নই। সহকর্মীরা বললেন, সুযোগ নাও, চেষ্টা করে দেখো। না পারলে ছেড়ে দিও।

এরপরেতো না করা কঠিন। ভাবলাম এমন কিছু করবো যা ঠিক প্রথাগত সাংবাদিকতা নয়, কিন্তু কোর সাংবাদিকতা। এই ভাবনা থেকে আমাদের ডিজিটাল মিডিয়া ’আলাপ'-এর জন্ম। আমি চেয়েছি মানুষ কথা বলুক, তার যা ইচ্ছে। নিয়মনীতি মেনে আমরা তা প্রকাশ করবো। নিত্য ঘটনার পেছনে ছুটব না আমরা, বরং ওই ঘটনার চারপাশের মানুষের উপলব্ধি বা কথা তুলে ধরবে আলাপ।

কতটুকু করতে পারবো জানি না। তবে বিশ্বাস করি, সহযোদ্ধা আহরার হোসেন এবং টিম চেষ্টায় কোনো ঘাটতি রাখবে না। 

আলাপের জন্ম স্বাধীনতার মাসে অর্থাৎ মার্চে। যখন আমরা আলাপের কথা ভাবছি, যাদের সাথেই কথা বলেছি, প্রায় সকলেই উৎসাহ দিয়েছে। সাহস জুগিয়েছে। সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। 

আমাদের অবস্থান বাংলাদেশের পক্ষে। মহান মুক্তিযুদ্ধ, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয়-রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সহাবস্থান, গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও মানবিক মর্যাদা, জনগণের ক্ষমতায়নসহ একটি ইনক্লুসিভ রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণে আলাপ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।

এরপরও কিছু মানুষের কথা আলাদা করে উল্লেখ করা দরকার। বিশেষ কৃতজ্ঞতা শিল্পী আনিসুজ্জামান সোহেলের প্রতি, অসাধারণ ডিজাইন ও শৈল্পিক দৃষ্টির জন্য। আলাপ ফন্ট তৈরির জন্য জ্যাকব থমাস, অনবদ্য প্রচেষ্টায় অফিস তৈরির জন্য শেলটেকের আর্কিটেক্ট দল এবং তরুণ সুরকার ধীয়ান গিরি, রোদেল ও তাদের টিমের প্রতিও কৃতজ্ঞতা তাদের সৃজনশীল সুরসজ্জার জন্য। আর সঙ্গে থাকা আলাপ-এর সব সহকর্মীকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

একদম পরিশেষে শেলটেক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব তানভীর আহমেদ এবং আলাপ হোল্ডিংস লিমিটেডের বোর্ডের সকল পরিচালকের প্রতি কৃতজ্ঞতা। কারণ তাদের সমর্থন, সাহসেই আলাপ একটি ৩৬০ ডিগ্রি ডিজিটাল মিডিয়া আউলেটের রূপ নিচ্ছে ধীরে ধীরে। 

আমাদের স্লোগান 'কথা চলুক'...

আমরা চাই আবাল, বৃদ্ধ-বনিতা, শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ সবাই কথা বলুক। নিজেদের মধ্যে আলাপ জারি থাকুক। কথা বলার অধিকার অন্তত অর্জিত হোক। কেননা, কথার চেয়ে সুন্দর কিছু নেই।

কথা চলুক...