আনিস আলমগীর, শাওন ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা কি 'ভিন্নমত দমন’

ফেসবুক পোস্ট, টেলিভিশন টক শো কিংবা ভিডিও বক্তব্যকে ফৌজদারি অভিযোগের ভিত্তি হয়ে যেতে দেখা গেছে।  আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনও বলছে, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সাংবাদিকতা ও ভিন্নমতের ওপর ধারাবাহিক চাপেরই আরেকটি অধ্যায়।  বিশ্লেষকরাও বলছেন, সরকার বদলালেও মতপ্রকাশের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি।

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:২৩ পিএম

ঢাকার উত্তরায় গভীর রাতে দায়ের হওয়া একটি অভিযোগ নতুন করে সামনে এনেছে বাংলাদেশের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রশ্ন। সাংবাদিক, অভিনেতা, মডেল, ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের কয়েকজন মানুষের বিরুদ্ধে একই মামলায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগে প্রশ্ন উঠেছে মতপ্রকাশের সীমারেখা এখন কতটা সংকুচিত। অন্তবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার শুরুতে নাগরিকদের ‘মন খুলে সমালোচনা’ করার আহ্বান জানিয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে ফেসবুক পোস্ট, টেলিভিশন টক শো কিংবা ভিডিও বক্তব্যকে ফৌজদারি অভিযোগের ভিত্তি হয়ে যেতে দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতিবেদনও বলছে, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং সাংবাদিকতা ও ভিন্নমতের ওপর ধারাবাহিক চাপেরই আরেকটি অধ্যায়। বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার বদলালেও মতপ্রকাশের প্রতি রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়নি।

রবিবার গভীর রাতে ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে সাংবাদিক আনিস আলমগীর, অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনসহ, মডেল মারিয়া কিসপট্টা ও উপস্থাপক ইমতু রাতিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। জুলাই রেভ্যুলেশনারি এলায়েন্সের কেন্দ্রীয় সংগঠক আরিয়ান আহমেদ এ অভিযোগ দায়ের করেন। সোমবার রাত আড়াইটার দিকে এই অভিযোগ দায়ের করা হয় বলে জানান উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি কাজী মোহাম্মদ রফিক।

অভিযোগে বলা হয়, ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্টের মাধ্যমে অভিযুক্তরা আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছেন। আরিয়ান আহমেদের দাবি, আওয়ামী লীগের অনুসারিরা দেশকে অস্থিতিশীল ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করছে।

তবে এই অভিযোগ দায়ের করার আগেই ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সাংবাদিক আনিস আলমগীরকে। রবিবার রাত পৌনে ৯টার দিকে তাকে ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, আনিস আলমগীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 
এরপর সোমবার দুপুরের দিকে তাকে গ্রেপ্তার দেখা হয়। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা নষ্টের ষড়যন্ত্র এবং নিষিদ্ধ সংগঠনকে উসকে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে।

উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়ের করা অভিযোগের এজাহারে আনিস আলমগীরের ভেরিফায়েড পেজ থেকে দেওয়া ২০২৪ সালের ২৫ জুলাইয়ের একটি পোস্ট উল্লেখ করা হয় যেখানে তিনি জুলাই আন্দোলন নিয়ে কথা বলেছিলেন। এ ছাড়াও ২০২৫ সালের ১২ ডিসেম্বর দেওয়া একটি পোস্টের ব্যাপারেও অভিযোগ করা হয় যেখানে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ওসমান হাদীর কথা উল্লেখ করেছেন আনিস আলমগীর। এ ছাড়া টকশোতে “জুলাই স্মৃতি জাদুঘর-ড. ইউনূসের বাড়ি ও গ্রামীণ ব্যাংকে হামলা হবে” বলে তিনি হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেন আরিয়ান। এর স্বপক্ষে একটি ইউটিউব লিংকও দেন তিনি।

অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওনের বিরুদ্ধেও একটি ফেসবুক পোস্ট যুক্ত করে অভিযোগ এনেছেন আরিয়ান আহমেদ। সেই ফেসবুক পোস্টে শেখ হাসিনার বক্তব্য সম্বলিত একটি ফটোকার্ড রয়েছে।
এ ছাড়া মডেল মারিয়া কিসপট্টার ফেসবুক থেকে দেওয়া তিনটি পোস্টের লিংক দিয়ে অভিযোগ করা হয়, তিনি আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার চেষ্টা করছেন। তবে ফেসবুক লিংকগুলোতে কিছু পাওয়া যায়নি। এমনকি মারিয়া কিসপট্টার ফেসবুক আইডিও এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না।

অভিনেতা ইমতু রাতিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে দুটি লিংক যুক্ত করেছেন আরিয়ান। সেখানে একটি লিংকে এখন প্রবেশ করা যাচ্ছে না। আরেকটি লিংকে দুটি স্ক্রিনশট শেয়ার করেছেন ইমতু রাতিশ। যেখানে শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য রয়েছে।

প্রশ্ন উঠেছে ফেসবুক পোস্টে কিংবা টক শোতে দেওয়া বক্তব্যের জন্য এভাবে আটক করা যায় কি না। এর আগেও ২০২৫ এর ফেব্রুয়ারিতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে অভিনয়শিল্পী মেহের আফরোজ শাওন ও সোহানা সাবাকে আটক করেছিল ডিবি। জিজ্ঞাসাবাদের পর পরেরদিন তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সে সময় ডিবির পক্ষ থেকে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি, শুধু জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলা হয়েছিল।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এ ধরনের মামলা ভীতির পরিবেশ তৈরি করছে। বিশ্বজুড়ে মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আর্টিকেল নাইনটিন। সংস্থাটির বাংলাদেশ অঞ্চলের হেড অব প্রোগ্রাম শাহনেওয়াজ পাটওয়ারী বলেন, “এই ধরনের মামলা আসলে ভীতির পরিবেশ তৈরি করে। এতে করে যারা সরকারের ব্যাপারে ক্রিটিকাল তারা কথা বলতে ভয় পাবে।”
সংস্থাটির  মুখপাত্র আরও বলেন, “মত দমনে এক ধরনের মব কালচার দেখা যাচ্ছে, এটাকে প্রেশার গ্রুপ বলা হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ে দায়িত্বশীল কেউ কথা বলেন না এবং গ্রেপ্তার করতেও দেখা যাচ্ছে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ মনে করেন, শুধু ফেসবুকে পোস্ট করা বা ইউটিউবে বলার জন্য কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। আলাপকে তিনি বলেন, “তাদের ডিবি সুপারভিশনে নিতে হবে এরকম  কোনো অপরাধ তারা করেছে বলে আমার মনে হয়নি।”

এটা এক ধরনের ভিন্নমত দমন উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আপনি এখনো একটা গোষ্ঠীর কাছে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত সারেন্ডার করছেন। এটা সরকারের দুর্বলতা চূড়ান্তভাবে প্রকাশ করে। তারা তো ইয়াং স্টার। তাদের ডেকেও বোঝনো যায়। তাদের বোঝানোর ক্যাপাসিটিও সরকারের নেই।”

অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ বলেন, “সরকারের তো একটা কাজের ধারা আছে। সেভাবে যদি কাজ করতে না পারে তবে সরকার থেকে লাভ কী।”

মত প্রকাশ নিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট উল্লেখ করা রয়েছে। সংবিধানের ৩৯। (১) ধারায় বলা হয়েছে,“চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।” বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা করে পরবর্তী ধারায় বলা হয়, (২) রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং (খ) সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।”

এ ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বজননী মানবাধিকার ঘোষণাপত্রেও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কথা উল্লেখ রয়েছে।

অন্তবর্তী সরকারও দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বারবার মত প্রকাশের স্বাধীনতার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করে আসছে। ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছিলেন, “আপনারা মন খুলে আমাদের সমালোচনা করুন।”

তবে ভিন্ন মত দমনের চিত্র উঠে এসেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে। ২০২৫ সালের ১০ ডিসেম্বর বিশ্ব মানবাধিকার দিবস উপলক্ষ্যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের অন্তবর্তীকালীন সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতা সমুন্নত রাখা ও সমালোচনাকে স্বাগত জানানোর ব্যাপারে অঙ্গীকার করেছে। তবে অক্টোবর পর্যন্ত অন্তত ১২৯ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং ২০০ জনের প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে কোনো প্রক্রিয়া মানা হয়নি। সরকার পরিবর্তন হলেও কোনো সিস্টেমের পরিবর্তন হয়নি এবং আগের মতোই নিপীড়নমূলক চর্চা অব্যাহত আছে। এ ছাড়া সেপ্টেম্বরে ফেসবুকে পোস্ট করা এক ভিডিওতে ড. ইউনূস ও কোরআন অবমাননা করায় একজনের বিরুদ্ধে তদন্তেরও নির্দেশ দেয় আদালত।”

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা আর্টিকেল নাইনটিন প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনেও বলা হয় বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ‘সংকটে রয়েছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত প্রতিবিদনে বলা হয়, “২০২৬ সালে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এই সময়ে অন্তবর্তী সরকারের জন্য সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
এ ছাড়া ২০২৫ সালের এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে গুগলের কাছে কনটেন্ট সরানোর ২৭৯টি অনুরোধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর বেশির ভাগই সরকারের সমালোচনামূলক। গুগলের মালিকানা প্রতিষ্ঠান অ্যালফাবেট প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৭৯টি অনুরোধ করেছে। এর মধ্যে সরকারের সমালোচনামূলক কনটেন্ট ছিল ১৮১টি, তার মধ্যে ৬৫ শতাংশ রিমুভ করেছে গুগল। এ ছাড়া জাতীয় স্বার্থেসংশ্লিস্ট অনুরোধ ছিল ৩টি, হেট স্পিচ ২টি।  

তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই দাবি অস্বীকার করা হয়েছে। নভেম্বরে দেওয়া এক বিবৃতিতে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, এমন কোনো অনুরোধ কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছে করা হয়নি। বিবৃতিতে বলা হয়, বিটিআরসি কিংবা এনটিএমসি বা কোনো বাংলাদেশি সংস্থােই কোনো সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার জন্য সরাসরি অনুরোধ করেনি।

শাহনেওয়াজ পাটওয়ারী মনে করেন, এভাবে ঢালাও মামলা ও অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করা আসলে এক ধরনের বার্তা দেওয়া। তিনি বলেন, এতে সরকারের আচরণ প্রকাশ পায়। সমালোচনামূলক কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ করা ভিন্ন মত দমনের অংশ কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সমালোচনামূলক কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ আসলে ভিন্ন মত দমনে পূর্ববর্তী সরকারের যে আচরণ তারই ধারাবাহিক আচরণ।”