ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ হয়েছে আগেই, এবার সেদেশ থেকে চাল আমদানিও স্থগিত করলো বাংলাদেশ।
সোমবার থেকে ভারত থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধার সব ধরনের চাল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করেছে বাংলাদেশ সরকার।
ওদিকে পাকিস্তান থেকে দুই লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির চুক্তি করেছে সরকার, যার মধ্যে ৫০ হাজার টন চাল বাংলাদেশে এসেও পড়েছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল শুরুর পর, ঢাকা়-করাচি রুটে সরাসরি ফ্লাইট চালু হতে যাচ্ছে- যা গত এক যুগেরও বেশি সময় বন্ধ ছিল।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক পালাবদলের পর পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নতুন গতি পাচ্ছে।
বিপরীতে, প্রতিবেশী ভারতকে ঘিরে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে অনেকে এখন ‘বরফশীতল’ বলেই আখ্যা দিচ্ছেন।
ভিসা জটিলতা, পোর্ট ব্যবহারের সুবিধা প্রত্যাহার, বাণিজ্য বন্ধের উদ্যোগ আর রাজনৈতিক টানাপোড়েনে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেমে গেছে তলানিতে।
এই পরিস্থিতির সরাসরি প্রভাব পড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। আমদানি ব্যয় বাড়ছে, কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।
ড. মোয়াজ্জেম বলছেন, “সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি হচ্ছে, তাতে ভারত ও বাংলাদেশ উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
“পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ থাকায় একদিকে বাংলাদেশে যেমন পেঁয়াজের দাম ১০০ টাকার ওপরে চলে গেছে, তেমনি রপ্তানির অভাবে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে পেঁয়াজ নষ্ট হচ্ছে। আবার একদিকে ভিসা জটিলতায় সাধারণ এবং মেডিক্যাল টুরিস্ট; যেমন- ভারত যেতে পারছে না, তেমনি এই কারণে এই সংশ্লিষ্ট ভারতীয় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
পাকিস্তানের সাথে সম্পর্কে নয়া মোড়
মূলত ২০২৪ সালের অগাস্ট পরবর্তী সময় থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খোলামেলা হতে থাকে। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে যা অনেকটাই ‘অবরুদ্ধ’ অবস্থার মতো ছিল।
গত দেড় বছরে বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে আমদানি-রপ্তানির গ্রাফও ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তার আগের বছরের তুলনায় দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে ২০ শতাংশ। আর এক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে পাকিস্তান।
গত অর্থবছরে পাকিস্তান থেকে আমদানি হয়েছে প্রায় ৭৮৭ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৭৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। সবমিলে বাণিজ্য পৌঁছেছে ৮৬৫ মিলিয়ন ডলারে।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসবিপির হিসেবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি পণ্যের রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ১৯ শতাংশ, বাংলাদেশি পণ্যের আমদানি বেড়েছে ৩৮ শতাংশের মতো।
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে পাকিস্তানি পণ্য রপ্তানি হয় প্রায় ৭৮ কোটি ৭০ লাখ ডলারের, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৬৬ কোটি ১০ লাখ ডলারের মতো।
ওদিকে সবশেষ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান আমদানি করে প্রায় ৭ কোটি ৮০ লাখ ডলারের পণ্য। আগের অর্থবছরে এটা ছিল পাঁচ কোটি ৬০ লাখ ডলারের মতো। সে হিসাবে বাংলাদেশ থেকে তাদের আমদানি বেড়েছে প্রায় ৩৮ শতাংশ।
এই বাণিজ্য চলতি বছরে আরও গতি পাবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিকরা।
গত বৃহস্পতিবার লাহোরে এক অনুষ্ঠানে পাকিস্তানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ইকবাল হুসেইন খান বলেন, “সরাসরি ফ্লাইট চালু দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ, যা দুই দেশের সম্পর্ক শক্তিশালী করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে”।
“এলসিসিআই এবং লাহোরে বাংলাদেশের অনারারি কনস্যুলেটের যৌথ সুপারিশে এ ভিসা দেওয়া হচ্ছে। আবেদনকারীদের তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ভিসা দেওয়া হবে। এতে দুই দেশের মধ্যে আসা-যাওয়া দ্রুততর ও সহজতর হবে,” যোগ করেন তিনি।
তের বছর পর সরাসরি ফ্লাইট চালুর জন্য প্রস্তুতি চলছে। শুরুতে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট চলাচল করবে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের দুটি বেসরকারি এয়ারলাইন্সকে ঢাকা-করাচি রুটে ফ্লাইট চালানোর অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ।
করাচির অনুষ্ঠানে হাইকমিশনার আরো জানান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি মালবাহী জাহাজের নিয়মিত চলাচল শিগগিরই চালু হতে যাচ্ছে।
গত বছরের ডিসেম্বরে করাচি থেকে একটি কার্গো জাহাজ আসে চট্টগ্রামে। ওই ঘটনা ছিল- স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মত বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে সরাসরি জাহাজ চলাচল।
এর আগে দুই দেশের মধ্যে পণ্য চলাচল হতো তৃতীয় কোনো দেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে দুবাই বা সিঙ্গাপুর ছিল প্রধান অবলম্বন।
প্রথম কার্গো আসার পর অনিয়মিতভাবে শুরু হয় দুই দেশের মধ্যে জাহাজ চলাচল। কিন্তু বাণিজ্য বাড়তে থাকায় নিয়মিত জাহাজ চলাচলের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন ইকবাল হুসেইন।
আগে তৃতীয় দেশ ব্যবহার করে করাচি থেকে চট্টগ্রামে মালামাল পৌঁছাতে সময় লাগত ২৩ দিনের মতো। সরাসরি কার্গো আসায় সেই সময় নেমে এসেছে ১০ দিনে।
পাকিস্তান আগে থেকেই বাংলাদেশে সামান্য পরিমাণ বাসমতি চাল রপ্তানি করত। কিন্তু সম্প্রতি দেশটি থেকে দুই লাখ টন চাল আমদানির চুক্তি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
ইকবাল হুসেইন বলেন, পাকিস্তান বাংলাদেশে চাল রপ্তানি করতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ পাকিস্তানে সরবরাহ করতে পারে তাজা আনারস।
এছাড়া বস্ত্র ও তৈরি পোশাক খাতেও দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে ইঙ্গিত দেন তিনি।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সে দেশের জাতীয় পরিষদে একটি লিখিত প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
সেখানে বলা হয়েছে, “বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে দুই দেশের বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় বেশ কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে। করাচি-চট্টগ্রাম সরাসরি শিপিং সেবা চালু হওয়ার ফলে এখন পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগছে মাত্র ১০ দিন। এতে লজিস্টিক ব্যবস্থার দক্ষতা বেড়েছে এবং পরিবহন ব্যয়ও কমেছে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ২০২৪ সালের ২৯এ সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্তানি পণ্যের জন্য বন্দরগুলোতে শতভাগ পরিদর্শন বাধ্যবাধকতা তুলে নিয়েছে।”
ওই প্রতিবেদনের বরাতে পাকিস্তানের সামা টিভির এক প্রতিবেদনে, ইসহাক দারের এ সিদ্ধান্তকে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ‘যুগান্তকারী অগ্রগতি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
“এর ফলে দুই দেশের মধ্যে আস্থা বাড়বে এবং পণ্য পরিবহনের গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। কাস্টমসে বিলম্ব কমে যাওয়ায় পাকিস্তানি রপ্তানি এখন বাংলাদেশের বাজারে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে,” ইসহাক দারকে উদ্ধৃত করে বলা হয় প্রতিবেদনে।
পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর লিখিত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা ও ডেনিম এক্সপোতে পাকিস্তানের দুই শতাধিক কোম্পানি অংশ নিয়েছে, যা বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও উৎপাদন খাতে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের প্রতিফলন।
ভারতের বাণিজ্য কি ধাক্কা খাবে?
নানারকম বাধার পরও আগের অর্থবছরের তুলনায় ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে। কিন্তু আগামীতেও এটা থাকবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানিতে গত চার মাসে তিন দফায় বিধিনিষেধ দিয়েছে ভারত।
গত ১৭ই মে ও ২৭এ জুন দুই দফায়- পোশাক, খাদ্যপণ্য, পাটপণ্য, তুলা ও সুতার বর্জ্য, প্লাস্টিকের পণ্য এবং কাঠের আসবাব রপ্তানিতে বিধিনিষেধ দেয় ভারত। তৃতীয় দফায় ১১ই অগাস্ট কয়েকটি পাটপণ্যে বিধিনিষেধ দেয় দেশটি।
এনবিআর-এর হিসাবে, গত জুলাইয়ে ভারতে মোট ১৪ কোটি ৯৪ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হিসাবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত ছিল বাংলাদেশের অষ্টম বড় রপ্তানি বাজার। দেশটিতে ওই অর্থবছরে ১৭৬ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ১২ দশমিক ৪৩ শতাংশ বেশি।
তবে চলতি বছরে এ আয়ে বড় ধরনের ধাক্কা আসতে পারে বলেই মনে করছে খাদ্যপণ্যের বড় রপ্তানিকারক প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা তৌহিদুজ্জামান বলেন, “জুনের পর থেকে ঘুরপথে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। এতে আমাদের সার্বিক খরচ ৮ থেকে ৯ শতাংশ বেড়েছে। এছাড়া গত কয়েক মাসের মধ্যেই রপ্তানিতে প্রায় ২০ শতাংশের মতো ঘাটতি দেখা যাচ্ছে।”
যদিও গত বছর চীনের পর ভারতই ছিল বাংলাদেশের পণ্য আমদানির দ্বিতীয় বড় উৎস।
ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে প্রায় ১১ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় তুলনায় তিন দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।
তবে বন্দর ব্যবহারের সুবিধা বাতিলসহ এই অর্থবছরে চাল, পেঁয়াজ, পাথরসহ নানা পণ্য রপ্তানিতে ভারতের দেওয়া কঠোরতা দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি খাতে প্রভাব ফেলতে পারে বলেই মনে করেছেন একাধিক ব্যবসায়ী।
ভারতের পেঁয়াজ রপ্তানিতে ধাক্কা
একটা সময় বছরের নির্দিষ্ট সময়ে পেঁয়াজ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দেয়াটা ছিল ভারতের স্বাভাবিক ঘটনা। আর এতে বাংলাদেশ পড়ত বড় ধরনের ঝামেলায়।
কিন্তু এবারের চিত্র ভিন্ন। নভেম্বরের মাঝামাঝি- যখন বাংলাদেশের নিজস্ব পেঁয়াজের সংকট থাকে, তখন ভারত থেকে আমদানি বন্ধ রয়েছে। একাধারে আট মাস ধরে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি কমেছে।
বাংলাদেশ আমদানি কমানোয় ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রভাব পড়ছে। পেঁয়াজ গুদামে পচতে শুরু করেছে বলে ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
ভারতের দ্য ইকোনমিক টাইমস এক প্রতিবেদনে বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারত থেকে ৭ লাখ ২৪ হাজার টন পেঁয়াজ কিনেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ একাই আমদানি করেছিল ৪২ শতাংশ পেঁয়াজ। তবে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে ভারত থেকে মাত্র ১২ হাজার ৯০০ টন পেঁয়াজ কিনেছে বাংলাদেশ।
বন্ধ চাল আমদানি
পয়লা ডিসেম্বর থেকে ভারতের চাল আমদানি বন্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার।
চট্টগ্রাম চাল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর আজম বলেন, “এতে একদিকে ভালোই হয়েছে। কারণ, নতুন চাল বাজারে আসছে। এটা না হলে কৃষকেরা সঠিক দাম পাবে না।
“তবে শুনতে পাচ্ছি, পাকিস্তান থেকে চাল আসবে। আসলে সরকার যেখান থেকে কমে আমদানি করতে পারবে, সেখান থেকেই পণ্য আমদানি করা উচিত,” বলেন তিনি।
এই ব্যবসায়ী আরো বলেন, “দেশের বাজার এবং আন্তর্জাতিক দর বিবেচনায় নিয়ে আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। “



