ঋণফাঁদ: বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের কাঁধে সোয়া লাখ টাকার দায়

দেশি-বিদেশি মিলিয়ে বাংলাদেশের সরকারের ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় সাড়ে ২১ লাখ কোটি টাকা। এই টাকা বাংলাদেশের প্রায় তিনটা বাজেটের সমান। চলতি বাজেট বরাদ্দের সাড়ে পনের শতাংশই খরচ হচ্ছে কেবল এই ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ। এনবিআর চেয়ারম্যান সম্প্রতি বলেছেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ফাঁদে পড়ে গেছে।

আপডেট : ১০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:৩১ পিএম

বেশি দিন আগের ঘটনা নয়, দেশটিও দূরের নয়। শ্রীলঙ্কা; জটিল অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল বৈদেশিক ঋণের ফাঁদে। একদিকে পুরানো ঋণ, সেটার সুদ ও কিস্তি পরিশোধে নতুন ঋণ। আটকে পড়েছিল এক দুষ্টচক্রে। অবস্থা এমন হয়েছিল যে মেটানো যাচ্ছিল না খাদ্য, ঔষধসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানি ব্যয় পর্যন্ত। তীব্র সংকটের মাঝে বাংলাদেশের কাছ থেকেও মিলিয়ন ডলারের ঋণ নিতে হয়েছিল তৎকালীন লঙ্কান সরকারকে। 

নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেও সামাল দেওয়া যায়নি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সেই সংকট। তার কয়েক মাসের মধ্যেই তীব্র গণরোষের মধ্যে বিদায় নিতে হয়েছিল মাহিন্দা রাজাপাকসা সরকারকে।  

গত পাঁচ বছর ধরে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণও বেড়েই চলেছে। নভেম্বরে অর্থ বিভাগের প্রকাশিত ঋণ বুলেটিন-এর পরিসংখ্যান বলছে, নানারকম উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ও বাজেট ঘাটতি মেটাতে বাংলাদেশ সরকারের নেয়া ঋণ ছাড়িয়ে গেছে রেকর্ড ২১ লাখ কোটি টাকা। যা বাংলাদেশের বাজেটের পৌনে তিনগুণ। 

সহজ করে বললে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ১,২৬,১৩৭ টাকা। 

বাংলাদেশের এই বিপুল পরিমাণ ঋণের বিপরীতে জমা হওয়া শুধু সুদ পরিশোধই সরকারের পরিচালন বাজেটের একটি একক বৃহত্তম ব্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ মোট ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। যা মোট বাজেটের প্রায় ১৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

এ নিয়ে উদ্বিগ্ন অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইতোমধ্যে ঋণের ফাঁদে পড়েছে বাংলাদেশ যা স্বীকার না করলে সামনে এগোনো যাবে না।

“আমরা একটা লংটার্ম ডেবট ট্র্যাপের বা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ফাঁদের দিকে যাচ্ছি কিনা”, নিজেই এমন প্রশ্ন করে এনবিআর চেয়ারম্যান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, “আসলে চলে গেছি অলরেডি। যতদিন আমরা সত্য স্বীকার না করব ততদিন আমরা এগোতে পারব না।“ 

“আমরা যদি প্রপারভাবে রাজস্ব আদায় করতে না পারি তাহলে দেশকে ক্রমাগত ঋণ করে করে বাজেট করতে হবে। এবং ডেফিনিটলি ঋণ পরিশোধ এবং সুদ পরিশোধের জন্য ম্যাক্রোইকনমিতে চাপ পড়বে,”- বলেন এনবিআর চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান।

সাড়ে ২১ লাখ কোটি টাকা ঋণ 

ঋণ-জিডিপি অনুপাত বেড়ে ৪০% এর ওপরে এবং রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত নেমে এসেছে ৭.৭%

১৩ই নভেম্বর প্রকাশিত অর্থ বিভাগের ঋণ বুলেটিনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের জুন শেষে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ ২১,৪৪,৩৪০ কোটি টাকা। 

যার মধ্যে বৈদেশিক ঋণ ৯,৪৯,০০০ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ ১১,৯৫,০০০ কোটি টাকা। 

অর্থাৎ মোট ঋণের মধ্যে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ৪৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। বাকিটা দেশের অভ্যন্তরে ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র, বন্ড, ট্রেজারি বিল বিক্রি থেকে নেয়া সরকারের ঋণ। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মাধ্যমে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের সুদের অর্থ পরিশোধের পরিমাণ গত বছরে ৪৩ শতাংশ বেড়েছে তার আগের বছরের তুলনায় ।

২০২১ সালে সরকারের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ২০ লাখ কোটি টাকা। যা মোট ঋণের প্রায় ৩৭ শতাংশ ছিল। অর্থাৎ, গত পাঁচ বছর ধরে বৈদেশিক ঋণ ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। 

অক্টোবরে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের বৃদ্ধির হার সবচেয়ে দ্রুত, যেখানে সরকারি ও সরকারি-গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ ১৩ বছরে তিনগুণেরও বেশি বেড়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সুদ পরিশোধের পরিমাণও বেড়ে গেছে। 

গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে সরকার সুদ হিসেবে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে, যা পূর্ববর্তী অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে বৈদেশিক ঋণের সুদের ক্ষেত্রে এই অর্থ পরিশোধ ২১ শতাংশ বেড়েছে, আর দেশীয় ঋণের সুদ ১৬ শতাংশ বেড়েছে। 

২০১৬ সালে সুদের অর্থ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। 

যা ২০২১ সালে বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ৬৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। 

বর্তমান সময়ে সরকারি ঋণের ধারা বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক জানিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে দেশ ঋণের ফাঁদে পড়বে। বাংলাদেশ এখন রাজস্ব সংকট, ঋণ পরিশোধের চাপ ও নীতিগত দুর্বলতায় এক ঝুঁকিপূর্ণ পথে হাঁটছে।” 

কেন উদ্বেগ

কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নয় পরিচালন বাজেটের বৃহত্তম ব্যয়ের খাত সুদ পরিশোধ

অর্থ বিভাগের ঋণ বুলেটিনে এই ঋণ বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কোভিডের পর উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলো থেকে পাওয়া বাজেট সহায়তা, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল ও মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ বড় প্রকল্পগুলোর জন্য করা ব্যাপক ব্যয়।

আবার এই ব্যয় মেটাতে যেভাবে রাজস্ব আয় বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল সেভাবে সরকার আয় বাড়াতে পারেনি। উলটো ধারাবাহিকভাবে কমছে দেশের কর-জিডিপির হার। 

এ নিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দেশের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে, যা ২০১৫ সালে ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। রাজস্ব সংগ্রহে ধীরগতির কারণে রাজস্ব বাজেটে কার্যত কোনও উদ্বৃত্ত নেই, যার ফলে সরকারকে উন্নয়ন ব্যয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক- উভয় ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলস্বরূপ সামগ্রিক ঋণ বাড়ছে।”

সরকারের নেয়া ঋণের ধরণ সম্পর্কে জানিয়ে তিনি আরও বলেন, “উদ্বেগের বিষয় হলো অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদের হারও এখন বেশি। একইসঙ্গে বিদেশি ঋণে অনুদান হয় খুব কম থাকে বা কোনো অনুদান থাকেই না। আবার এসব ঋণের বেশিরভাগ কঠিন শর্তের সঙ্গে সুদ হারও থাকে অনেক উচ্চ রেটে। পরিশোধের সময়ও কম থাকে। সামগ্রিক এসব পরিস্থিতি দেশের ঋণ পরিশোধের চাপ তীব্রভাবে বাড়াচ্ছে।”

দীর্ঘমেয়াদে ঋণ টেকসই রাখার ক্ষেত্রে বুলেটিনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, আরও শৃঙ্খলাবদ্ধ ঋণ ব্যবস্থাপনা, নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের কঠোর যাচাই, বাস্তবায়ন দক্ষতার উন্নয়ন, রাজস্ব আহরণের ত্বরান্বিত ব্যবস্থা এবং রপ্তানি আয় সম্প্রসারণ ও বৈচিত্র্যকরণের প্রতি আরও গভীর মনোযোগ প্রয়োজন।

সতর্কসংকেত

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের হিসাবে কোনো উন্নয়নশীল দেশের জন্য ৪০% থেকে ৬০% ঋণ-জিডিপি অনুপাত সতর্কতামূলক সীমা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। 

এদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের মোট ঋণ-জিডিপি অনুপাত প্রায় ৩৯.৩৭% ধরা হলেও বিভিন্ন তথ্যমতে এটি ৪০% অতিক্রম করেছে।

চলমান ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে এ নিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে আইএমএফ। বাংলাদেশের চলমান ঋণ সংকটকে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংকের যৌথ বিশ্লেষণেও “মধ্যম ঝুঁকি” তালিকায় রয়েছে।

তবে আইএমএফ এর নিজস্ব মূল্যায়ন কাঠামোতে বাংলাদেশ “মাঝারি ঋণ বহন ক্ষমতা” সম্পন্ন দেশ। সে হিসেবে বাংলাদেশের ঋণের বোঝা জিডিপির প্রায় ৫৫% বা তার বেশি হলে তা গুরুতর উদ্বেগের কারণ হতে পারে উল্লেখ করা হয়েছে। 

অর্থ বিভাগের ঋণ সংক্রান্ত বুলেটিনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ-জিডিপি অনুপাত এখনও মধ্যম পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) 'সুরক্ষিত সীমা’র মধ্যে রয়েছে, তবে কিছু অর্থনৈতিক সূচক এখন সতর্কতার সংকেত দিচ্ছে।

আইএমএফ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির কথা উল্লেখ করে ২০২৬ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের ওপর একটি সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে। 

এই সীমার অধীনে বাংলাদেশ এই অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে পারবে। এর মধ্যে প্রথম প্রান্তিকে ১ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার এবং প্রথমার্ধে ৩ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছে। আইএমএফ তার ঋণ কর্মসূচির অধীনে ত্রৈমাসিকভাবে এই ধরনের ঋণ পর্যবেক্ষণ করছে।

বৈদেশিক ঋণ নেয়ার ব্যাপারে সতর্ক করেছেন অর্থনীতিবিদ মোস্তাফিজুর রহমানও। 

তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সুদহার, ঋণের উৎস, পরিশোধ সময়সূচি এবং ছাড়ের সময়কাল সাবধানে বিবেচনা করতে হবে, যেন নতুন ঋণ কেবল পুরানো ঋণ পরিশোধে ব্যবহার না হয়। এটা হলে ঋণের চক্রে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।”

তিনি বলেন, “কর ব্যবস্থায় ভয়াবহ অদক্ষতা রয়েছে। চার লাখ পয়েন্টে ভোক্তারা ভ্যাট দেন, কিন্তু সরকারি কোষাগারে ভ্যাট আসে মাত্র ২৪ হাজার পয়েন্ট থেকে। এটি সরাসরি দুর্নীতির প্রমাণ। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের তথ্য একীভূত না করলে কর ফাঁকি বন্ধ হবে না।”

তিনি সতর্ক করে বলেন, “সুদ পরিশোধ ইতোমধ্যে রাজস্ব বাজেটে কৃষি ও শিক্ষাকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যয়। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ ঋণের ফাঁদে পড়তে পারে।”