মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর পার হলেও বাংলাদেশ এখনও এমন এক ধরনের বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে জাতির জন্ম দেওয়া মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরেই বারবার ফিরে আসছে নানা প্রশ্ন, বিতর্ক ও বিভাজন।
শহিদের প্রকৃত সংখ্যা কত, মুক্তিযোদ্ধার তালিকা কেন এখনও বিতর্কিত, স্বাধীনতার ঘোষক কে, রাজাকারের সঠিক সংখ্যা ও তালিকা কেন প্রস্তুত হয় না- এসব নিয়ে প্রশ্ন।
সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বিস্ফোরকভাবে যুক্ত হয়েছে ‘একাত্তর-চব্বিশ’ ঘিরে বিতর্ক।
এসব প্রশ্ন শুধু যে ইতিহাস ঘিরে তাই নয়; বরং রাষ্ট্র, রাজনীতি ও জাতিগত পরিচয়ের গভীর সংকটের দিকে ইঙ্গিত করে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এখানে বাস্তবতা হলো- রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে মুক্তিযুদ্ধের বয়ান বদলে যায়।
যে রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসে, সবাই মুক্তিযুদ্ধকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চায়। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধ কোনও নিরপেক্ষ জাতীয় স্মৃতি হয়ে ওঠার বদলে ক্রমেই পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের অস্ত্রে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর সেই পুরোনো রেওয়াজ আবারও দৃশ্যমান।
নতুন বাস্তবতায় মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে পুরোনো বিতর্কগুলো শুধু ফিরেই আসেনি বরং নতুন মাত্রাও যোগ হয়েছে।
একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশকে প্রতিস্থাপন করার আকাঙ্ক্ষা, কিংবা নতুন রাষ্ট্রীয় ভিত্তি ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টায় মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক অবস্থান নিয়ে নতুন করে আলোচনা হচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও কেন এসব মৌলিক বিষয়ে জাতিগত ঐকমত্য গড়ে ওঠেনি? এগুলো কি কেবল তথ্যগত অস্পষ্টতা, নাকি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব?

বিতর্ক শুরু কীভাবে?
নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনী। এই বিজয়ের মাধ্যমে শুরু হয় নতুন দেশের পথচলা।
নতুন রাষ্ট্র হিসেবে যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়, তখন বিশ্ব রাজনীতি ছিলো টালমাটাল, শীতল যুদ্ধের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল।
ওই সময় পৃথিবীর প্রায় সব ফ্রন্টেই আমেরিকা ও রাশিয়া প্রক্সি যুদ্ধে অংশ নেয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি রণাঙ্গনে উপস্থিত থাকার প্রস্তুতিও চলছিল তাদের। কিন্তু তার আগেই পরাজিত হয় পাকিস্তানি বাহিনী।
‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ বইয়ে গবেষক ও লেখক গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, “বহির্বিশ্বে বাঙালিদের পরিচিতি আগে সামান্যই ছিলো। কিন্তু একটা স্বাধীন দেশের দৌলতে এখন তাদের পরিচিতি বিশ্বের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে।”
কিন্তু যে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতির জন্ম হলো- সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এত প্রশ্ন কবে থেকে শুরু হলো?
“বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে পরের দিন থেকে,” বলেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, লেখক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী।
“তবে ঘোষকের বিতর্কটা পঁচাত্তরের আগ পর্যন্ত ছিল না,” যোগ করেন তিনি।

স্বাধীনতার ঘোষক কে?
স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পৌনে চার বছর ক্ষমতায় ছিলো আওয়ামী লীগ। পঁচাত্তরের পনেরোই অগাস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান নেতা এবং তখনকার রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান।
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে পরিবর্তন আসে। কে ঘোষণা করেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়?
কিন্তু এটা শুধু প্রশ্ন থাকেনি, রাজনৈতিক বিতর্কে পরিণত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে গবেষকদেরও।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লেখা হয়েছে- “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।”
এই ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত থাকায় সাংবিধানিকভাবে শেখ মুজিবই স্বাধীনতার ঘোষক।
পঁচাত্তরে ক্ষমতার পালাবদলের পর থেকেই ঘোষক নিয়ে প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর ১৯৮১ সালে সংসদের শোক প্রস্তাবে তাকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে উপস্থাপন করার পর থেকেই এই বিতর্ক জোরালো হয়।
বিএনপির পক্ষ থেকে জিয়াউর রহমানকে ঘোষক দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে ওঠে এবং দলটির জনপ্রিয় স্লোগানগুলোর একটি হলো এই ঘোষক নিয়ে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্যতম গ্রন্থ হলো ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র’। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ১৫ খণ্ডের এই বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে উল্লেখ আছে।
সেখানে লেখা হয়েছে, “১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতের পরপরই, অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা বাংলাদেশের সর্বত্র সম্প্রচারের উদ্দেশ্যে তখনকার ইপিআর (সাবেক ইপিআর) ট্রান্সমিটার ব্যবহার করে প্রচারের জন্য চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন।”
পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা হয় বলে উল্লেখ আছে বইয়ে।
২৬ মার্চ দুপুরে এম এ হান্নান এবং ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন বলে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন গোলাম মুরশিদ।
“চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগঠক মোহাম্মদ বেলাল লিখেছেন যে, সেদিন দুপুরের পরে পাঁচ মিনিটের জন্য প্রচারিত একটি বিশেষ অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবের নামে এই ঘোষণাপত্র পাঠ করে এম এ হান্নান।”
“২৬ মার্চ আগরতলা থেকেও এই ঘোষণা শোনা গিয়েছিলো বলে ২৭শে মার্চের লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায় খবর বেরিয়েছিলো,” লিখেছেন গোলাম মুরশিদ।
জিয়াউর রহমান সামরিক কর্মকর্তা হওয়ায় তার কণ্ঠ অনেককে অনুপ্রাণিত ও সাহস জুগিয়েছিলো বলে মনে করেন গবেষক আফসান চৌধুরী।
“উনারটা (জিয়াউর রহমান) আমিও শুনেছি। আমার বাবার সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের কথা হয়েছিল। বাবাকে তাজউদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন, ঘোষণাটা শুনে আমরা খুব উজ্জীবিত হয়েছিলাম। কারণ আমরা ভাবলাম, তাহলে সেনাবাহিনী আমাদের সাথে আছে। এবং সেইটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল।”
জিয়াউর রহমানের কণ্ঠ তখন কীভাবে উৎসাহ জুগিয়েছিলো- তা লিখেছেন গোলাম মুরশিদ।
“তাঁর (জিয়াউর রহমান) ঘোষণা বাংলাদেশের যেসব জায়গায় শোনা গিয়েছিলো, সেসব জায়গার লোকেরা দারুণ উৎসাহিত হয়েছিলেন।”
স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে প্রামাণ্য দলিল থাকার পরও রাজনৈতিক মতবিরোধ চরমে পৌঁছায়। জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে তার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি।
আওয়ামী লীগ এই দাবি ভাঙতে আক্রমণাত্মক নানা প্রচারণা চালাতে থাকে। এমনকি জিয়াউর রহমান যে মুক্তিযোদ্ধা নন, ২০০৯ সালের পর থেকে সেটিও প্রচার শুরু করে।
আফসান চৌধুরী মনে করেন, জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের একটা বড় চরিত্র।
“উনি বিরাট ক্যারেক্টার। আবার আওয়ামী লীগ আমলে তাকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলেছিলো। এগুলো তো বলার কোনো মানে হয় না।”

শহিদদের সংখ্যা
মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপক গণহত্যার সংখ্যা নিয়ে জাতিগত বিভক্তি চরম আকার ধারণ করেছে। এই সংখ্যা নিয়ে মতবিরোধ আছে ইতিহাসবিদদের মধ্যেও। তবে সবচেয়ে আলোচিত সংখ্যাটি হলো ৩০ লাখ।
মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ নাকি এর বেশি বা কম মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল না নিয়ে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন মত দিয়েছেন।
কোনও কোনও লেখক মনে করেন, ৩০ লাখ সংখ্যার বিষয়টি এসেছে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য থেকে।
তিনি বলেছিলেন, “Kill three million of them, and the rest will eat out of our hands" (তাদের ৩০ লাখকে হত্যা করো, বাকিরা আমাদের হাতের মুঠোয় থাকবে)।
এই বক্তব্য গণহত্যার নৃশংসতা ও তীব্রতাকে নির্দেশ করে বলে মনে করেন অনেকেই। বিভিন্ন গবেষক ও লেখক বিভিন্ন ধরনের তথ্য দেন- যে সংখ্যা ১০ থেকে ৩০ লাখের মতো বলে তাদের ধারণা।
আফসান চৌধুরী বলেন, “কয়েকজন গবেষক তো বলেছেন, ৪০ থেকে ৫০ লাখ হবে।”
“আসলে সংখ্যাটা প্রমাণিত না, রাজনৈতিক বিষয়,” যোগ করেন তিনি।
আফসান চৌধুরী স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র বইয়ের গবেষকদের একজন। তার লেখা উল্লেখযোগ্য আরও একটি বই হলো ‘১৯৭১: গণনির্যাতন-গণহত্যা’।
তিনি বলেন, “যখন সংখ্যার কথা বলি, তো তাহলে তার একটা প্রক্রিয়া আছে। আমরা সেই প্রক্রিয়া দিয়ে কোনোদিন কিছু করেছি কি না?”
এই গবেষক মনে করেন, সংখ্যাটা যদি ‘এত বড় বিষয় হয়ে থাকে’, তাহলে গবেষণার মাধ্যমে ঠিক করতে হবে। কারণ, এটা ধারণা করার মতো কোনও বিষয় না।
আরও পড়ুন: ১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে জামায়াতের ন্যারেটিভ, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও সত্য
মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরও বাংলাদেশের কোনও সরকার, কখনোই শহিদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণে কাজ করেনি। শহিদদের তালিকাও নেই রাষ্ট্রের কাছে।
আফসান চৌধুরী মনে করেন, সংখ্যার হিসাবটা রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে।
“যে তথ্যই আসুক, সেই তথ্য আরও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করবে। আমার মনে হয়, এটাকে (ইস্যু) ঘুমাতে দেওয়া উচিৎ। কারণ এর কোনও শেষ তো আর হবে না।”

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা
মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার পর থেকেই, তবে বারবার পরিবর্তন ও পরিমার্জন এ নিয়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সাবেক স্বৈরশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সময় ১৯৮৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়।
১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে আরেকটি তালিকা করা হয। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আরেকটি তালিকা করে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আরেকটি কমিটি হয়।
এরপর ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এলে, আবার নতুন করে তালিকা প্রণয়ন শুরু করে আওয়ামী লীগ। ২০২৪ এর অগাস্টে পতনের আগে এই তালিকা প্রণয়নের কাজ চলছিল।
অন্তর্বর্তী সরকার এসে ফের নতুনভাবে কাজ শুরু করেছে।
গত কয়েক দশকে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে কাজ করেছে সবাই।
কিন্তু সঠিক তালিকা নিয়ে গ্রহণযোগ্য কোনও সমাধানে আসতে পারেনি কেউ। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন অনেকে।
এমনকি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও বয়স নির্ধারণ নিয়েও বিতর্ক চলমান।
রাজাকারের তালিকা
রাজাকারের তালিকা তৈরি করতে পারেনি কোনও সরকার। এর আগে একটি প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেও বাতিল করা আওয়ামী লীগ সরকার।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রাথমিক ওই তালিকাটি প্রকাশ করে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে।
এই তালিকা প্রকাশের পর দেশজুড়ে ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। কয়েকদিনের মধ্যেই তা প্রত্যাহার করে বাতিল করা হয়।

একাত্তর-চব্বিশ বিতর্ক
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে বিতর্কগুলো তীব্র হয়েছে- তার মধ্যে অন্যতম ইতিহাস, বৈধতা ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকার।
এটাকে অনেকেই বলছেন- ‘একাত্তর বনাম চব্বিশ’ বয়ানের লড়াই।
‘নতুন বন্দোবস্ত’, ‘নতুন স্বাধীনতা’ এখন এমন রাজনৈতিক শব্দ, যেখানে অবধারিতভাবে চলে আসছে একাত্তর ও চব্বিশের প্রসঙ্গ।
বিতর্কের প্রধান জায়গা হলো- মুক্তিযুদ্ধ কি বাংলাদেশের রাষ্ট্রগঠনের একমাত্র ভিত্তি হিসেবে থাকবে, না-কি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে নতুন ‘ফাউন্ডিং মোমেন্ট’ হিসেবে দাঁড় করানো হবে।
চব্বিশকে সামনে এনে একাত্তরের ঐতিহাসিক ও নৈতিক অবস্থানকে ‘খাটো’ করার চেষ্টা চলছে বলে মনে করেন অনেকেই।
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে যারা ছিলেন, তারাই পরে এনসিপি নামে নতুন রাজনৈতিক দল গড়ে তোলেন।
এনসিপির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা মনে করি জুলাই ২০২৪ গণঅভ্যুত্থান আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে।”
এই সেকেন্ড রিপাবলিকের ব্যাখ্যায় অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। তাদের একজন হলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী।
গত মার্চে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকাকে তিনি বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের পর আমরা একটা রিপাবলিক পেয়েছি। কিন্তু সেটা যেহেতু জনগণের আকাঙ্ক্ষার নিকট অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, তাই গণঅভ্যুত্থান হয়েছে।”
“ফলে বাংলাদেশ আমূল পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে আছে। এজন্য রাষ্ট্রীয় সংবিধান বিলোপ করে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত করতে হবে। আর সেটাই হবে সেকেন্ড রিপাবলিক।”
অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার চব্বিশের অভ্যুত্থানকে ‘নতুন স্বাধীনতা’ হিসেবে উল্লেখ করেন।
এটা নিয়ে রাজনৈতিক বাহাস শুরু হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “১৯৭১ ও ২০২৪ এক নয়।”
বিশ্লেষকরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, একাত্তরের সঙ্গে চব্বিশের রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। তাই এই নিয়ে বিতর্কের সুযোগই নেই।
একাত্তর-চব্বিশ বিতর্ককে পাত্তা দিতেই রাজি না আফসান চৌধুরী। তিনি বলেন, “এটাকে নিয়ে এত টেনশন করার কিছু নাই। অনেক কিছু, প্রচুর জিনিস আছে আমাদের টেনশনের।”
“এইটা মানুষের রাজনীতি। পলিটিক্যাল ইমাজিনেশনে রাষ্ট্র শুরু হয়েছে কবে থেকে? রাষ্ট্র শুরু হয়েছে, একাত্তর থেকে। তো তাহলে কেউ যদি বলে যে এটা নতুন একটা ব্যবস্থা, তাহলে ওটাকে ইজ্জত দেয়ার জন্য সে বলছে। এর বেশি কিছু না।”
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দলীয়করণের সংস্কৃতি ঐতিহ্যগত। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের বয়ানকে আওয়ামী লীগ দলীয় কাজে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করেছে বলেও সমালোচনা আছে।
আফসান চৌধুরী বলেন, “যখন মানুষ বলেছে, হ্যাঁ- একমাত্র আমরাই করেছি। তার প্রতি একটা রিঅ্যাকশান হয়েছে। সেই প্রতিক্রিয়া থেকেই মানুষের এখন অস্বীকারের একটা চরম পর্যায় পর্যন্ত যায়। তাতে কিছু এসে যায় না।”
“এর একটা বড় কারণ হচ্ছে, মানুষজন ভাবতে চাচ্ছে না যে দেশ স্বাধীন হয়েছে কি হয়নি। মানুষ তো দেখতে পাচ্ছে, তার চারিদিকে কী হয়েছে না হয়েছে। সে তো এইটার মধ্যে বসবাস করে। থাকছে, খাচ্ছে, পরছে, চাকরি করছে, সংসার করছে, ছেলেমেয়েরা বড় হচ্ছে, স্কুলে যাচ্ছে- এটাই তার জীবন।”
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এমন কিছু ঘটনা ঘটে, যাতে বিতর্কের পাশাপাশি সৃষ্টি হয় আশঙ্কাও।
স্বাধীনতা জাদুঘরসহ মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রহশালা এবং ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো আক্রান্ত, ভাঙচুর ও লুটপাট চলেছে অবাধে।
মুক্তিসংগ্রামে বাঙালিদের ওপর ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার কথা তুলে ধরেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক।
তিনি বলেন, “পরাজিত শক্তি, শক্তিশালী ছিল এবং ভয়ংকর নিষ্ঠুরও ছিল। আমাদের বিজয়ের মধ্য দিয়েই, তাদের সমস্ত কিছু অবসান হয়ে গেলো, তাতো হয়নি। ওইটা (মুক্তিযুদ্ধ) বিতর্কিত করার চেষ্টা নানাভাবে চলে।”

বিতর্কের শেষ কোথায়?
স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক চলে ঐতিহাসিক ঘটনা ও চরিত্রগুলো নির্মাণের ক্ষেত্রে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করেছে ব্যাপকভাবে। এমনকি পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধের ‘বিকৃত ইতিহাস’ জুড়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে। সরকার বদল হলে পাঠ্যপুস্তকও বদলানো হয়।
মফিদুল হক বলেন, “আমাদের এখানে সবটাকেই একটা রাজনৈতিক জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়।
আমরাও অনেক বেশি রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে নিমজ্জিত থাকি। আমরা যদি ইতিহাস চর্চার মধ্যে যাই, তাহলে এই বিতর্কগুলো অনেক পরিষ্কার হয়ে যায়।”
গোলাম মুরশিদ লিখেছেন, “সবচেয়ে বিকৃত ইতিহাস লিখেছেন, যাঁরা দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন, তাঁরা। বিশেষ করে রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং দলীয় আনুগত্যের কারণে অনেকে রীতিমতো ইতিহাস দখলের প্রয়াস চালিয়েছেন।”
“মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিতে যে বাংলাদেশ গঠিত হয়েছিলো, কয়েক বছরের মধ্যে তার চেহারা বদলে যাওয়ায়, তরুণ সমাজ যে ইতিহাসের কথা শুনেছেন, তার অনেকটাই ভিত্তিহীন অথবা আংশিক সত্য।”
আফসান চৌধুরী বলেন, “কিন্তু যেটা হচ্ছে না, সেটা হচ্ছে যে, মানুষের ইতিহাসটা তো হচ্ছে না। আমরা কেবলমাত্র ভাবছি যে, রাষ্ট্রের ইতিহাসটাই প্রধান ইতিহাস। অথচ প্রধান ইতিহাসটা হচ্ছে মানুষের ইতিহাস এবং এই সমাজটা কিন্তু মানুষের নির্মিত একাত্তর।”
এই প্রসঙ্গে তিনি মিত্র বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং অরোরার প্রসঙ্গ টানেন।
“জগজিৎ সিং অরোরা আমাকে বলেছিলেন, তোমরা তো জিজ্ঞাসা করো খালি সেনাবাহিনীর কথা। একটা প্রশ্নের কথা ভেবেছো? বাংলাদেশের কৃষক যদি আমাদের অনুমতি না দিতো, আমরা কি বাংলাদেশে ঢুকতে পারতাম?
“একটা যৌথ বাহিনীর প্রধান যে সারেন্ডারের সেরেমনিতে ছিল, সে স্বীকৃতি দিচ্ছে কৃষকের। আমরা দেইনি। তো এখন কী বলার আছে? অতএব এর দামটা আমরা চুকাচ্ছি বিতর্ক সৃষ্টির মাধ্যমে।”



