অপরাধীদের স্বজনদের গ্রেফতারে আইন কী বলছে 

ফৌজদারি অপরাধের দায় যেখানে ব্যক্তিগত হওয়ার কথা, সেখানে কেন বারবার অভিযুক্তের স্বজনেরাও ‘হয়রানি’র শিকার হন। আর এতে করে অভিযুক্তরা অনেক সময় সাধারণ মানুষের সহানুভতিও পান বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

আপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৩৮ এএম

একটি গুলির ঘটনার তদন্ত গড়াতে গড়াতে আবারও এসে ঠেকেছে পুরোনো এক বিতর্কে। মূল অভিযুক্ত পলাতক, গ্রেফতার করা হয়েছে তার বাবা-মাকে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদীকে গুলির ঘটনায় র‌্যাব ও ডিবির ভাষ্য অনুযায়ী ‘প্রাথমিক সত্যতা’র ভিত্তিতে হাদি হত্যাচেষ্টার মূল আসামি ফয়সল করিম মাসুদের বাবা-মাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ‘তদন্তের স্বার্থে’ আর কিছুই জানায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তবে এই ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে রাষ্ট্রের তদন্ত পদ্ধতি ও আইনি ব্যবস্থা নিয়ে। ফৌজদারি অপরাধের দায় যেখানে ব্যক্তিগত হওয়ার কথা, সেখানে কেন বারবার অভিযুক্তের স্বজনেরাও ‘হয়রানি’র শিকার হন। আর এতে করে অভিযুক্তরা অনেক সময় সাধারণ মানুষের সহানুভতিও পান বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

ওসমান হাদি হত্যাচেষ্টা মামলার মূল আসামির বাবা-মাকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে নতুন করে এই আইনি প্রশ্ন সামনে এসেছে। এটিকে অপরাধ তদন্তের দীর্ঘদিনের যে সংস্কৃতি তারই প্রতিফলন বলে মনে করা হচ্ছে।

মঙ্গলবার ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে র‍্যাব-১০ ঢাকা কেরানীগঞ্জে অভিযান চালিয়ে ফয়সলের বাবা মো. হুমায়ুন কবির (৭০) ও মা মোসা. হাসি বেগম (৬০) গ্রেফতার করে।

র‍্যাব-১০ এর সিনিয়র এসআই তাপস কর্মকার আলাপ-কে বলেছেন, এই ঘটনায় জড়িত থাকার অপরাধে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলেই তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

পরে আবার র‌্যাবের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই কেসটা বর্তমানে ডিবি তদন্ত করছে। তাই ‘তদন্তের স্বার্থে’ এর বেশি তথ্য দেওয়া যাচ্ছে না।

ফয়সলের বাবা-মাকে গ্রেফতারের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল ইসলাম আলাপ-কে বলেন, “আমাদের কাছে কিছু প্রমাণ অবশ্যই আছে। সেজন্যই তাদের গ্রেফতার করা হয়ে ফয়সলের ব্যাগে অস্ত্র ছিল এবং তা তার বাবা জানতো।” 

গ্রেফতারের পর র‌্যাবের পক্ষ থেকে দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, হুমায়ুন-হাসি দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে ফয়সল তৃতীয়। ফয়সল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে তার বোন মোসা. জেসমিন আক্তারের বাসায় প্রায়ই যাতায়াত করতেন। ঘটনার দিন রাতে জেসমিনের বাসায় একটি ব্যাগ নিয়ে ওঠেন ফয়সল। পরে বাসার ফাঁকা জায়গা দিয়ে ব্যাগটি ফেলে দেন। আবার আসামি তার ভাগনে জামিলকে (১৮) দিয়ে ব্যাগটি নিয়ে আসেন। আসামি তার ব্যবহৃত দুটি মুঠোফোনের একটি বাসার ছাদ থেকে ফেলে দেন। অন্যটি তার মাকে দেন। সেখানে তিনি তার মা–বাবার সঙ্গে দেখা করেন। 

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, অবস্থান নিরাপদ মনে না হওয়ায় ফয়সল অবস্থান পরিবর্তন করে। আগারগাঁও থেকে মিরপুর, পরে শাহজাদপুরে বাবা হুমায়ুনের ভাতিজা আরিফের বাসায় যান। 

র‌্যাব জানায়, “ফয়সালের ব্যাগ নিয়ে তার বাবা হুমায়ুন একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে দেন। সঙ্গে কিছু টাকাও দেন। পরে হুমায়ুন-হাসি দম্পতি ছোট ছেলে হাসান মাহমুদের কেরানীগঞ্জের বাসায় যান। তারা জুরাইন থেকে দুটি সিম কিনে ব্যবহার করেন।”

অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা না থাকলে কাউকে গ্রেফতার করা বেআইনি; শুধুমাত্র সহযোগী হলে তা করা যায় বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার সরোয়ার হোসেন।   

“ফৌজদারি অপরাধের দায় ব্যক্তির। কারও দায়ের জন্য কেউ দায়ী না। বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এই কাজটাই করে,” আলাপ-কে তিনি বলেন।

আসামিকে না পেয়ে তার বাবা-মা, সন্তান কিংবা অন্যান্য স্বজনকে গ্রেফতার করার ঘটনা বেশ পুরোনো।  

২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম রবির বাসায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ তার ছেলেকে আটক করে। পুলিশ সদস্যরা সেসময় তার বাসায় অবস্থান করে এবং ফোন করে জানতে চান রবি কোথায়। না পেয়ে তার ২০ বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে যায় পুলিশ। 

২০১৫ সালেও এমন ঘটনা ঘটেছিল। ঝিনাইদহে এরশাদ হোসেন নামের এক কলেজ ছাত্রকে গ্রেফতার করতে অভিযান চালায় পুলিশ। সেসময় তাকে না পেয়ে তার বাবা মইন উদ্দিনকে আটক করা হয়।

এ ধরণের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় বলে মনে করেন রাজনীতি পর্যবেক্ষক হাসান মামুন।    

“পর্যবেক্ষক হিসেবে আমি বলতে পারি, পুরোনো ধারাতেই তদন্ত চলছে বলে মনে হয়। পুলিশের মধ্যে কাজের ধারায় কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। এমনকি এত বড় ঘটনার পরও,” আলাপ-কে বলেন তিনি।

এই ধরনের ঘটনা আগেও ঘটেছে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, “এসব বাদ দিলে কি আমরা দ্রুত তদন্ত করতে পারবো কি না সেটা বুঝতে হবে। কারণ ইনভেস্টিগেশন একটা জটিল বিষয়। যে দায়িত্বে থাকেন, তার ওপর প্রেশার থাকে।”

এটা নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত মন্তব্য করে তিনি বলেন, “কাউকে হ্যারাস না করে কীভাবে তদন্ত করা যেতে পারে তা নিয়ে রিসার্চ হওয়া উচিত। কারণ এতে উলটো অভিযুক্তের প্রতি সহানুভূতি বাড়ে।”

যারা অভিযুক্ত, বিচার শেষ হওয়ার আগে তাদের অপরাধী বলা ঠিক না মন্তব্য করে হাসান মামুন বলেন, স্বজনরা যদি পুলিশের হয়রানির শিকার হয়, তবে অভিযুক্তের জন্য এক ধরনের সহানুভূতি তৈরি হয়। 

“বাবা-মা বৃদ্ধ, তারা তো আর অপরাধে যুক্ত না। তারা যদি কোনোভাবে সহায়তা না করে, তাহলে তারা তো অপরাধী না। অনেক বাবা-মা এমন ছেলে-মেয়ে নিয়ে বিপদেই আছে,” তিনি বলেন।

অনেক বাবা-মা খবরও রাখে না তার সন্তান কী করছে উল্লেখ করে হাসান মামুন বলেন, “এগুলো সামাজিক দায়। ছেলে যদি অপরাধে জড়ায়। সেগুলোর এক ধরনের নৈতিক দায় বাবা-মার ওপর আসতেই পারে। কিন্তু এর টেকনিক্যাল দায় তাদের ওপর আসে কি না। এটা দেখার বিষয়। উন্নত দেশে কী করা হয়, আমার মনে হয় সেটা একটু অনুসরণ করা উচিত।”

বিষয়টি নিয়ে একটু গবেষণা হওয়া প্রয়োজন উল্লেখ করে হাসান মামুন বলেন, “বাংলাদেশের মতো সমমানের দেশগুলো কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং আমাদের চেয়ে উচ্চমানের দেশগুলো এইসব অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নিচ্ছে সেগুলো বিচার করা দরকার।”

ফয়সলের বাবা-মাকে গ্রেফতারের ব্যাপারে রাজনীতি বিশ্লেষক শুভ কিবরিয়া বলেন, “তাকে তো সন্দেহভাজন হিসেবেই খোঁজা হচ্ছে। একজন সন্দেহভাজনকে খুঁজতে গেলে কী কী সূত্র ট্রেস করে তাকে পাওয়া যেতে পারে তা করা হয়। সেই হিসাবে তো অতীতেও আমরা দেখেছি যে কোনো আসামিকে যখন পায় না তখন তার নিকটাত্মীয়দের আনা হয়। সেই প্রক্রিয়ার একটা অংশ হিসেবে এটা কি না আমি জানি না। ”

শুভ কিবরিয়া বলেন, “আমরা তো খুব একটা সুশাসনের মধ্যে আছি সেটা বলবো না। আমরা একটা হিংসা বিদ্বেষ-প্রতিহিংসা, একটা নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে অনেক বছর ধরে চলছি। সুতরাং আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যে একেবারে কেতাব মেনে, বইয়ে লেখা এবং সমস্ত মানবাধিকারের নর্মস মেনে যে চলে সেটা তো বলা যায় না।”

তিনি বলেন, “আমাদের কালচার তো বদলায়নি, আমরা একই কালচারের মধ্যে আছি। সুতরাং এটাকে আমি সেই হিসাবেই দেখি।”

ভুল-ত্রুটির মধ্য দিয়ে যেতে হবে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, “আমরা আমাদের জাতীয় আকাঙ্খার ক্ষেত্রে ব্যক্তিগতভাবে, দলগতভাবে ও রাজনৈতিকভাবে কতটা নৈতিকতার পরিচয় দিচ্ছি সেটা একটা বিবেচ্য বিষয়।” 

শুভ কিবরিয়া বলেন, “আমার বেলায় যখন ঘটনা ঘটছে তখন মানবাধিকার-নৈতিকতার কথা বলছি। আরেকজনের বেলায় যখন ঘটছে তখন মানবাধিকার-নৈতিকতার কথা যাচ্ছে না। এই ডুয়েলিটির বেসিক কারণ হচ্ছে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ দাঁড়ায়নি। রাষ্ট্র হিসেবে যদি দাঁড়াতো আমরা সবাই আইনের কাছে নিরাপদ থাকতাম। আমরা কেউই আইনে হাতে নিরাপদ থাকিনি, থাকতে দেইনি। যে যখন ক্ষমতায় আসছে সেভাবে ব্যবহার করেছে। সেই কালচার পরিবর্তন হয়নি।”

আসামিকে না পেয়ে স্বজনকে গ্রেপ্তার করার এই প্রবণতা নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক ঘটনা নতুন করে সেই বিষয়টি সামনে এনেছে। রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতার কারণে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।