বিরানব্বই দিনের মধ্যে কোটিপতিরা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নিয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। কোথায় যাচ্ছে, কী কাজে খরচ হচ্ছে এত টাকা?
মেরাজ মেভিজ
প্রকাশ : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:০৬ পিএমআপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৪০ পিএম
জুন প্রান্তিকের তুলনায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ৭৩৪টি।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন বাংলাদেশের ধনীরা। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিরানব্বই দিনের মধ্যে তারা ব্যাংক থেকে তুলেছেন প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দেশে কোটিপতি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে।
২০২৪ সালের ৫ই অগাস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সমসাময়িক সময়েও এমন চিত্র দেখা গিয়েছিল। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে বড় অঙ্কের আমানতকারীদের সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। সে সময় কমেছিল কোটি টাকা বা তার বেশি জমা রয়েছে- এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা। তবে সেটাও এই অর্থের অর্ধেকেরও কম।
অস্থির সেই সময়ের পর কোটি টাকার বড় আমানতকারীরা তাদের অর্থ নিয়ে আবারও ফিরছিলেন ব্যাংকে। বাড়ছিল তাদের আমানতের পরিমাণ কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যান বলছে আবারও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করেছেন ধনীরা।
মাত্র ৯২ দিনের মধ্যে কোথায় গেল এত টাকা? বিশেষ করে দেশে যখন বিনিয়োগ স্থবির, আবার অর্থ পাচারের কোনো সুনির্দিষ্ট ট্রেন্ড নেই; কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রিজার্ভ। তাহলে কোটিপতিরা এত টাকা তুলে কী করছেন? মূল্যস্ফীতির আঘাত কি কোটিপতিদের জন্য এতটাই অসহনীয় হয়ে পড়েছে যে তাদের সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে? নাকি প্রাক নির্বাচনি লেনদেনে ব্যয় হচ্ছে বিপুল অর্থ?
অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারদের কাছ থেকে এসব প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আসছে। কেউ বলছেন ব্যাংকের প্রতি অনাস্থা এবং মূল্যস্ফীতির চাপ। কেউবা বলছেন হয়তো টাকা উড়ছে নির্বাচনের মাঠে।
আবার ধারণা করা হচ্ছে, উচ্চ জীবন ব্যয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ‘পেটি বুর্জোয়া’ বা ‘ছোট কোটিপতি’রা, যাদের আমানত এক থেকে তিন কোটি টাকার মধ্যে; তারা হয়তো আমানত ভাঙছেন।
অর্থনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ব্যাংকের প্রতি এক ধরনের অনাস্থা রয়েছে। এ কারণে দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে কিছু অর্থ সরে থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে পুরো অর্থই এক ব্যাংক থেকে সরে আরেক ব্যাংকে যাবে। আরেকটা অর্থনৈতিক কারণ মূল্যস্ফীতির চাপ থাকায় খরচ বেড়েছে। তবে এটা বড় কোটিপতিদের আমানতে প্রভাব ফেলার কথা নয়।”
কোটিপতি আমানতে ধাক্কা
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ‘শিডিউলড ব্যাংক স্ট্যাটিসটিকস’-এর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জুন শেষে কোটি টাকার হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৮০ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। আর সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এসব হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টে জমা কমেছে ৫৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
যদিও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে দেশের ব্যাংক খাতে কোটিপতি গ্রাহকের সংখ্যা। জুন, ২০২৫ প্রান্তিকে কোটি টাকার বেশি আমানত থাকা হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টি। আর সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০টি। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে কোটি টাকার বেশি জমা থাকা হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৭৩৪টি।
চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় জুন প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে কোটিপতি গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছিল পাঁচ হাজার ৯৭৪টি। আর জুন প্রান্তিকের তুলনায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ৭৩৪টি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক সরকারের অভাবের মাঝেও দেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কিন্তু কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানও। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক অ্যাকাউন্টও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার একাধিক কোটি টাকার হিসাব যেমন রয়েছে তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও রয়েছে একাধিক কোটি টাকার হিসাব।
টাকা তোলার ট্রেন্ড
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে কেউ কেউ টাকা তুলে বাড়ির সিন্দুকে রাখতে পারেন বলেও ধারণা করছেন কোনো কোনো ব্যাংকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “খেয়াল করলে দেখবেন বড় অঙ্কের সম্পদধারীরা বরাবরই রাজনৈতিক ও নীতিগত পরিবেশের বিষয়ে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের সময়েও ব্যাংক থেকে টাকা ওঠানোর ট্রেন্ড দেখা গিয়েছিল।”
পরিবেশ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা গেলে তাদের মধ্যে নিরাপদ স্থানে অর্থ স্থানান্তরের প্রবণতা বেড়ে যায়। ব্যাংক খাতে বড় অঙ্কের আমানত হিসাব কমার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি বলেই মনে করছেন এই ব্যাংকার।
২০২৪-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবে মোট জমা ছিল ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। এর ঠিক আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২৪-এর এপ্রিল-জুন সময়ে জমা ছিল ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক সময়ে কোটিপতি অ্যাকাউন্টগুলিতে আমানতের পরিমাণ কমেছিল ২৬,১৮৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এমন প্রবণতা থেকে ধারণা করা যায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বড় আমানতকারীরা বেশি সতর্ক হয়ে পড়েন। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকে যারা টাকা রেখেছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি হতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংকের ভিত্তি বিবেচনায় বড় অঙ্কের আমানত একটিমাত্র হিসাবে রাখাটাও অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্ককে ছোট ছোট হিসাবে ভাগসহ অন্য খাতে স্থানান্তরের প্রবণতাও ঘটে থাকতে পারে।’
সেই সময়ে অবশ্য কমেছিল কোটি টাকা বা তার বেশি আমানতকারী ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও। তখন এ ধরনের অ্যাকাউন্ট কমেছিল ১,৬৫৮টি।
ছোট কোটিপতি
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “দেশে কিন্তু বিনিয়োগ বাড়েনি। আবার টাকা পাচারের কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি। সেক্ষেত্রে একটা হতে পারে ছোট কোটিপতি বা বুর্জোয়া গোষ্ঠী তাদের জীবন যাপনের মান ধরে রাখতে হয়ত হিমশিম খাচ্ছে। তারা নিজেদের সঞ্চয়ে হয়ত হাত দিচ্ছেন। হতে পারে মাঝারি ব্যবসায়িদের অনেকেরই হয়ত আগেরমতো উপার্জন নেই। কিন্তু তার জীবন মান তো ধরে রাখতে হচ্ছে।”
ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়টি আরেকটি দৃষ্টি থেকে ব্যাখ্যা করে বলেন, “এখন সরকারি একজন চাকরিজীবী অবসরের পর অবসরভাতাসহ সব মিলিয়ে কোটি টাকার ওপরে পেয়ে থাকেন। ধরেন তিনি এই টাকা বাৎসরিক ১০ শতাংশ সুদে মাসে হয়ত ৮০ হাজার টাকা পেয়ে আসছিলেন এবং এই অর্থেই তিনি চলছিলেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির ধারাবাহিক চাপে আগের খরচের সঙ্গে মেলাতে পারছেন না তখন কিন্তু তার সঞ্চয়ে আঘাত পড়বে।”
২০২৫-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরের ৯২ দিন সময়ে ৫৯,২০৯ কোটি টাকার বিপরীতে ২০২৪-এর একই সময়ে উঠেছিল ২৬,১৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এবার কোটিপতিরা আগের তুলনায় তুলেছেন ৩৩,০২২ কোটি টাকা বেশি।
এবারও কী রাজনৈতিক কোনো প্রভাব রয়েছে, জানতে চাইলে দুই অর্থনীতিবিদই প্রাক-নির্বাচনি খাতে কোটিপতিদের অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ে নিজেদের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, “নির্বাচনের ব্যয় শুরু না হলেও প্রাক-নির্বাচনি ব্যয় কিন্তু হচ্ছে। বিভিন্ন দল তাদের মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। এখানে অর্থের লেনদেন হয়ে থাকতেও পারে।”
অন্যদিকে, এ ধরনের লেনদেন হয়ে থাকলে সেটা নির্বাচন কমিশনসহ সরকারি সংস্থাগুলোর তদন্ত করে দেখা উচিত বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
বাংলাদেশের কোটিপতি গ্রাফ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন। ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি।
২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এ আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টি।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৯৭৬টিতে।
২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টিতে এবং সবশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ লাখ ২২ হাজার ৮১টি ছিল। এখন এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজারে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সব ধরনের অ্যাকাউন্ট মিলে বেড়েছে আমানত এবং হিসাবের সংখ্যা। সেপ্টেম্বর শেষে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৩১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। যা চলতি বছরের জুন শেষে ছিল ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা।
সেই হিসাবে তিন মাসে এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৩৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট হিসাবসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৯০ লাখ দুই হাজার ৬৭১। যা সেপ্টেম্বরের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ১৭ কোটি ৪৫ লাখ ৯৬ হাজার ৭০০।
সেই হিসাবে তিন মাসে ব্যাংক খাতের মোট হিসাবসংখ্যা বেড়েছে ৫৫ লাখ ৯৪ হাজার ২৯টি।
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন কোটিপতিরা
বিরানব্বই দিনের মধ্যে কোটিপতিরা তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তুলে নিয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। কোথায় যাচ্ছে, কী কাজে খরচ হচ্ছে এত টাকা?
ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন বাংলাদেশের ধনীরা। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বিরানব্বই দিনের মধ্যে তারা ব্যাংক থেকে তুলেছেন প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দেশে কোটিপতি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা কমেনি বরং বেড়েছে।
২০২৪ সালের ৫ই অগাস্টে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সমসাময়িক সময়েও এমন চিত্র দেখা গিয়েছিল। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে বড় অঙ্কের আমানতকারীদের সরে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। সে সময় কমেছিল কোটি টাকা বা তার বেশি জমা রয়েছে- এমন অ্যাকাউন্টের সংখ্যা। তবে সেটাও এই অর্থের অর্ধেকেরও কম।
অস্থির সেই সময়ের পর কোটি টাকার বড় আমানতকারীরা তাদের অর্থ নিয়ে আবারও ফিরছিলেন ব্যাংকে। বাড়ছিল তাদের আমানতের পরিমাণ কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবশেষ পরিসংখ্যান বলছে আবারও ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিতে শুরু করেছেন ধনীরা।
মাত্র ৯২ দিনের মধ্যে কোথায় গেল এত টাকা? বিশেষ করে দেশে যখন বিনিয়োগ স্থবির, আবার অর্থ পাচারের কোনো সুনির্দিষ্ট ট্রেন্ড নেই; কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে রিজার্ভ। তাহলে কোটিপতিরা এত টাকা তুলে কী করছেন? মূল্যস্ফীতির আঘাত কি কোটিপতিদের জন্য এতটাই অসহনীয় হয়ে পড়েছে যে তাদের সঞ্চয় ভাঙতে হচ্ছে? নাকি প্রাক নির্বাচনি লেনদেনে ব্যয় হচ্ছে বিপুল অর্থ?
অর্থনীতিবিদ, ব্যাংকারদের কাছ থেকে এসব প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা আসছে। কেউ বলছেন ব্যাংকের প্রতি অনাস্থা এবং মূল্যস্ফীতির চাপ। কেউবা বলছেন হয়তো টাকা উড়ছে নির্বাচনের মাঠে।
আবার ধারণা করা হচ্ছে, উচ্চ জীবন ব্যয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে ‘পেটি বুর্জোয়া’ বা ‘ছোট কোটিপতি’রা, যাদের আমানত এক থেকে তিন কোটি টাকার মধ্যে; তারা হয়তো আমানত ভাঙছেন।
অর্থনীতি বিষয়ক বিশ্লেষক ও বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ব্যাংকের প্রতি এক ধরনের অনাস্থা রয়েছে। এ কারণে দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে কিছু অর্থ সরে থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে পুরো অর্থই এক ব্যাংক থেকে সরে আরেক ব্যাংকে যাবে। আরেকটা অর্থনৈতিক কারণ মূল্যস্ফীতির চাপ থাকায় খরচ বেড়েছে। তবে এটা বড় কোটিপতিদের আমানতে প্রভাব ফেলার কথা নয়।”
কোটিপতি আমানতে ধাক্কা
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত ‘শিডিউলড ব্যাংক স্ট্যাটিসটিকস’-এর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, চলতি বছরের জুন শেষে কোটি টাকার হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ ছিল ৮ লাখ ৮০ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। আর সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এসব হিসাবে জমা টাকার পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২১ হাজার ৫৬২ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে কোটিপতিদের অ্যাকাউন্টে জমা কমেছে ৫৯ হাজার ২০৯ কোটি টাকা।
যদিও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে দেশের ব্যাংক খাতে কোটিপতি গ্রাহকের সংখ্যা। জুন, ২০২৫ প্রান্তিকে কোটি টাকার বেশি আমানত থাকা হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৭ হাজার ৩৩৬টি। আর সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০টি। সেই হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে কোটি টাকার বেশি জমা থাকা হিসাব সংখ্যা বেড়েছে ৭৩৪টি।
চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিকের তুলনায় জুন প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে কোটিপতি গ্রাহকের সংখ্যা বেড়েছিল পাঁচ হাজার ৯৭৪টি। আর জুন প্রান্তিকের তুলনায় সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে কোটিপতি অ্যাকাউন্টের সংখ্যা বেড়েছে ৭৩৪টি।
উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং রাজনৈতিক সরকারের অভাবের মাঝেও দেশে কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেছেন, কোটি টাকার হিসাব মানেই কিন্তু কোটিপতি ব্যক্তির হিসাব নয়। কারণ ব্যাংকে এক কোটি টাকার বেশি অর্থ রাখার তালিকায় ব্যক্তি ছাড়া রয়েছে অনেক প্রতিষ্ঠানও। আবার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কতটি ব্যাংক হিসাব খুলতে পারবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। ফলে এক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির একাধিক অ্যাকাউন্টও রয়েছে। এর মধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার একাধিক কোটি টাকার হিসাব যেমন রয়েছে তেমনি ব্যক্তি পর্যায়েও রয়েছে একাধিক কোটি টাকার হিসাব।
টাকা তোলার ট্রেন্ড
নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে কেউ কেউ টাকা তুলে বাড়ির সিন্দুকে রাখতে পারেন বলেও ধারণা করছেন কোনো কোনো ব্যাংকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, “খেয়াল করলে দেখবেন বড় অঙ্কের সম্পদধারীরা বরাবরই রাজনৈতিক ও নীতিগত পরিবেশের বিষয়ে অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানের সময়েও ব্যাংক থেকে টাকা ওঠানোর ট্রেন্ড দেখা গিয়েছিল।”
পরিবেশ পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা গেলে তাদের মধ্যে নিরাপদ স্থানে অর্থ স্থানান্তরের প্রবণতা বেড়ে যায়। ব্যাংক খাতে বড় অঙ্কের আমানত হিসাব কমার ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি বলেই মনে করছেন এই ব্যাংকার।
২০২৪-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এক কোটি টাকার বেশি আমানত রয়েছে, এমন ব্যাংক হিসাবে মোট জমা ছিল ৭ লাখ ৪৬ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। এর ঠিক আগের প্রান্তিকে অর্থাৎ ২০২৪-এর এপ্রিল-জুন সময়ে জমা ছিল ৭ লাখ ৭৩ হাজার ৫৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ, জুলাই-অগাস্টের গণঅভ্যুত্থান এবং পরিবর্তিত রাজনৈতিক সময়ে কোটিপতি অ্যাকাউন্টগুলিতে আমানতের পরিমাণ কমেছিল ২৬,১৮৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউ অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘এমন প্রবণতা থেকে ধারণা করা যায়, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বড় আমানতকারীরা বেশি সতর্ক হয়ে পড়েন। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকে যারা টাকা রেখেছিলেন, তাদের ক্ষেত্রে এই প্রবণতা বেশি হতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংকের ভিত্তি বিবেচনায় বড় অঙ্কের আমানত একটিমাত্র হিসাবে রাখাটাও অনেকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছেন। এ ক্ষেত্রে বড় অঙ্ককে ছোট ছোট হিসাবে ভাগসহ অন্য খাতে স্থানান্তরের প্রবণতাও ঘটে থাকতে পারে।’
সেই সময়ে অবশ্য কমেছিল কোটি টাকা বা তার বেশি আমানতকারী ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও। তখন এ ধরনের অ্যাকাউন্ট কমেছিল ১,৬৫৮টি।
ছোট কোটিপতি
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “দেশে কিন্তু বিনিয়োগ বাড়েনি। আবার টাকা পাচারের কোনো লক্ষণও দেখা যায়নি। সেক্ষেত্রে একটা হতে পারে ছোট কোটিপতি বা বুর্জোয়া গোষ্ঠী তাদের জীবন যাপনের মান ধরে রাখতে হয়ত হিমশিম খাচ্ছে। তারা নিজেদের সঞ্চয়ে হয়ত হাত দিচ্ছেন। হতে পারে মাঝারি ব্যবসায়িদের অনেকেরই হয়ত আগেরমতো উপার্জন নেই। কিন্তু তার জীবন মান তো ধরে রাখতে হচ্ছে।”
ড. মোস্তাফিজুর রহমান এ বিষয়টি আরেকটি দৃষ্টি থেকে ব্যাখ্যা করে বলেন, “এখন সরকারি একজন চাকরিজীবী অবসরের পর অবসরভাতাসহ সব মিলিয়ে কোটি টাকার ওপরে পেয়ে থাকেন। ধরেন তিনি এই টাকা বাৎসরিক ১০ শতাংশ সুদে মাসে হয়ত ৮০ হাজার টাকা পেয়ে আসছিলেন এবং এই অর্থেই তিনি চলছিলেন। কিন্তু মূল্যস্ফীতির ধারাবাহিক চাপে আগের খরচের সঙ্গে মেলাতে পারছেন না তখন কিন্তু তার সঞ্চয়ে আঘাত পড়বে।”
২০২৫-এর জুলাই-সেপ্টেম্বরের ৯২ দিন সময়ে ৫৯,২০৯ কোটি টাকার বিপরীতে ২০২৪-এর একই সময়ে উঠেছিল ২৬,১৮৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ এবার কোটিপতিরা আগের তুলনায় তুলেছেন ৩৩,০২২ কোটি টাকা বেশি।
এবারও কী রাজনৈতিক কোনো প্রভাব রয়েছে, জানতে চাইলে দুই অর্থনীতিবিদই প্রাক-নির্বাচনি খাতে কোটিপতিদের অর্থ ব্যয়ের বিষয়টি নিয়ে নিজেদের আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন।
জাহিদ হোসেন বলেন, “নির্বাচনের ব্যয় শুরু না হলেও প্রাক-নির্বাচনি ব্যয় কিন্তু হচ্ছে। বিভিন্ন দল তাদের মনোনয়ন ঘোষণা করেছে। এখানে অর্থের লেনদেন হয়ে থাকতেও পারে।”
অন্যদিকে, এ ধরনের লেনদেন হয়ে থাকলে সেটা নির্বাচন কমিশনসহ সরকারি সংস্থাগুলোর তদন্ত করে দেখা উচিত বলে মনে করেন মোস্তাফিজুর রহমান।
বাংলাদেশের কোটিপতি গ্রাফ
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ৫ জন। ১৯৭৫ সালে তা ৪৭ জনে উন্নীত হয়। ১৯৮০ সালে কোটিপতিদের হিসাবধারীর সংখ্যা ছিল ৯৮টি। এরপর ১৯৯০ সালে ৯৪৩টি, ১৯৯৬ সালে ২ হাজার ৫৯৪ জন, ২০০১ সালে ৫ হাজার ১৬২টি, ২০০৬ সালে ৮ হাজার ৮৮৭টি এবং ২০০৮ সালে ছিল ১৯ হাজার ১৬৩টি।
২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে এ আমানতকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৩ হাজার ৮৯০টি।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে তা দাঁড়ায় ১ লাখ ১৯৭৬টিতে।
২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই হিসাবের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৯ হাজার ৯৪৬টি।
২০২৩ সালের ডিসেম্বরে দাঁড়ায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৯০৮টিতে এবং সবশেষ ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ১ লাখ ২২ হাজার ৮১টি ছিল। এখন এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৮ হাজারে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সব ধরনের অ্যাকাউন্ট মিলে বেড়েছে আমানত এবং হিসাবের সংখ্যা। সেপ্টেম্বর শেষে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ লাখ ৩১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। যা চলতি বছরের জুন শেষে ছিল ১৯ লাখ ৯৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা।
সেই হিসাবে তিন মাসে এসব হিসাবে আমানতের পরিমাণ বেড়েছে ৩৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা।
চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংক খাতে মোট হিসাবসংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৯০ লাখ দুই হাজার ৬৭১। যা সেপ্টেম্বরের সবশেষ হিসাব অনুযায়ী ১৭ কোটি ৪৫ লাখ ৯৬ হাজার ৭০০।
সেই হিসাবে তিন মাসে ব্যাংক খাতের মোট হিসাবসংখ্যা বেড়েছে ৫৫ লাখ ৯৪ হাজার ২৯টি।