ভোটের মাঠে জোটের হিসাব

এনসিপির জোট এবং জাতীয় পার্টির সাবেক দুই নেতার জোট- ভোটের ফলাফলে ‘প্রভাব’ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক।    

আপডেট : ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:০২ পিএম

ভোট এলেই রাজনৈতিক দলগুলোর জোট বাঁধার যে সংস্কৃতি বাংলাদেশে রয়েছে- এবারও শুরু হয়েছে সেই তোড়জোড়।  

কিছু রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম ও কর্মসূচি অন্যান্য সময় তেমন চোখে না পড়লেও, সেসব ‘ব্রাত্য’দের কদর বাড়ে নির্বাচনের আগে। এবারও দেখা যাচ্ছে তাদের দৌড়ঝাঁপ।  

আগামী নির্বাচন ঘিরে কয়েকটি জোটের কথা শোনা গেলেও বেশি আলোচনায় রয়েছে মূলত তিনটা জোট। এগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে- বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি।  

সবচেয়ে বেশি দল নিয়ে জোট করতে যাচ্ছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গীদের নিয়ে ভোটের মাঠে নামছে চার মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি। 

এবার ভোটের মাঠে জামায়াতে ইসলামী নামছে ভিন্নরূপে। দলটি সর্বশেষ এককভাবে নির্বাচন করেছিল ১৯৯৬ সালে। তারপর থেকে ছিল বিএনপির জোট ও ভোটসঙ্গী। 

কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এবার একটি জোটের নেতৃত্বে থাকছে জামায়াতে ইসলামী। এই রাজনৈতিক মোর্চায় আটটি ইসলামী দল এক হয়েছে। 

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে যেসব তরুণরা সামনের কাতারে ছিলেন, পরে তারাই গড়ে তুলেছেন নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপি। 

নতুন এই দলও জোটবদ্ধ হতে চলেছে সমমনাদের নিয়ে- যেখানে আছে আরও দুইটি দল। 

সাবেক মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে হয়েছে ২০ দলীয় জোট। 

এনসিপির জোট এবং জাতীয় পার্টির সাবেক দুই নেতার জোট- ভোটের ফলাফলে ‘প্রভাব’ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক।    

সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ভোটের রাজনীতির জোটেই নির্ভরশীলতা জমে উঠেছে। তবে জোটের রাজনীতি নিয়ে রয়েছে সমালোচনা। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক শুভ কিবরিয়া বলেন, “কোনো দলের সঙ্গে জোট বেঁধে হেরে যাওয়ার চেয়ে, এককভাবে হেরে যাওয়াটা- রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য ভালো।”

জোটের হিসাবনিকাশ

১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট সামনে রেখে বুধবার রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিনের সাথে দেখা করবেন সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। 

জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে রাষ্ট্রপতির সাথে নির্বাচন কমিশনারদের দেখা করার প্রথা রয়েছে। 

আগামী নির্বাচনে এখন পর্যন্ত সম্ভাব্য পাঁচটা জোট ভোটের মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে। 

সবচেয়ে বড় দল বিএনপির সঙ্গে আছে ১২ দলীয় জোট, ১১ দলের জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, পাঁচ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ। এ ছাড়া রয়েছে- এলডিপি, বিজেপি, এনডিএম, গণঅধিকার পরিষদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও গণফোরাম।  

জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে নির্বাচনি সমঝোতায় রয়েছে- ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জাগপা ও বিডিপি।

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা এখনও জোট ঘোষণা দেয়নি। 

নতুন আত্মপ্রকাশ করা এনসিপির নেতৃত্বে জোট ঘোষণা করা হয়েছে রবিবার।

ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন গণঅধিকার পরিষদের এই জোটে থাকার গুঞ্জন থাকলেও তা আর হচ্ছে না। 

এনসিপির জোটে আছে এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন। নাম দেওয়া হয়েছে গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট। 

বামপন্থী দল সিপিবি, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, বাংলাদেশ জাসদ, ঐক্য-ন্যাপ, বাসদ (মাহবুব) মিলে গঠন করেছে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট। এরা ভোটের জোট কিনা তা এখনো নিশ্চিত না।  

জি এম কাদেরের সঙ্গে নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের নেতৃত্বে গত অগাস্টে জাতীয় পার্টি ভেঙে একই নামে গড়ে ওঠে আরেকটি দল। 

জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট নামে একটি নির্বাচনি মোর্চার ঘোষণা দিয়েছে তারা। তাদের সঙ্গে রয়েছেন- আনোয়ার হোসেন মঞ্জু নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি), জাপা (মতিন), মুসলিম লীগ, এনপিপিসহ মোট ২০ দল।

আওয়ামী লীগ সরকার সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় আনিসুল ও মঞ্জু ছিলেন মন্ত্রী। একাধিকবার সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। 

নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধিত ৫৬ দলের মধ্যে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম স্থগিত। 

আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকা ১৪ দলীয় জোটের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ, তরীকত ফেডারেশনসহ কয়েকটি দলের দৃশ্যমান কোনো কার্যক্রম নেই।

ভোটের মাঠে ১৪ দলের শরিকরা অনুপস্থিত থাকবেন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

সাবেক রাষ্ট্রপতি একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিকল্পধারা বাংলাদেশ নামের রাজনৈতিক দল। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল দলটি। এবারের ভোটে দলটি থাকবে কি না, তা এখনো জানানো হয়নি।  

এবার হিসাব ভিন্ন

আরপিও সংশোধনের পর এবার জোটসঙ্গী হলেও অন্যদলের প্রতীক নিয়ে ভোট করার সুযোগ থাকছে না। লড়তে হবে নিজ দলের প্রতীকে। 

তাই এবারের জোটের রাজনীতি অন্য সময়ের চেয়ে আলাদা বলে মনে করেন বিশ্লেষক শুভ কিবরিয়া।

“আরপিও সংশোধনীর কারণে জোট শরিক হলেও, নিজ নিজ প্রতীকে নির্বাচন করতে হবে। তাই জোটের শরিকরা সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে পারবেন না।” 

বিএনপির আসন ভাগাভাগি

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি ঢাকা-১৩ ও ঢাকা-১৭ আসনে।

দুই দফায় ২৭২ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। ধারণা করা হচ্ছে, বাকি ২৮টি আসন তারা জোট শরিকদের জন্য ছেড়ে দেবে। 

প্রথম তালিকা ঘোষণার পর অনেকগুলো আসনে জোট ও মিত্রদের মনোনয়ন দেওয়ার ইঙ্গিত দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম।

তিনি বলেছিলেন, "আমাদের সঙ্গে যারা যুগপৎ আন্দোলন করেছেন, যে সমস্ত আসনে তারা আগ্রহী, সে সমস্ত আসনগুলোতে আমরা কোনো প্রার্থী দিইনি। আমরা আশা করছি তারা তাদের নাম ঘোষণা করবেন, তখন আমরা চূড়ান্ত করব।"

ঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেনি ঢাকা-১৩ ও ঢাকা-১৭ আসনে।

ঢাকা-১৩ আসনে প্রচার চালাচ্ছেন এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ছিল এনডিএম। 

ঢাকা-১৭ আসনে সক্রিয় আছেন বিএনপির শরীক দল, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) আন্দালিব রহমান পার্থ। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসনেও প্রার্থী দেয়নি বিএনপি। এই আসনে জোটের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আলোচনায় রয়েছেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি।

বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করা হয়নি বগুড়া-২ ও চট্টগ্রাম-১৪ আসনেও। এই দুই আসনে বিএনপির নির্বাচনি জোটের প্রার্থী হয়ে লড়তে পারেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এলডিপির সভাপতি অলি আহমদের ছেলে অধ্যাপক ওমর ফারুক।

জামায়াতের হিসাব

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দিয়েছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি।

চলতি বছরের শুরুতে আসনভিত্তিক সম্ভাব্য প্রার্থী ঘোষণা শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। সেইসব প্রার্থীরা সভ, কর্মী সম্মেলন, উঠান বৈঠক ও গণসংযোগ করে ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। 

জামায়াতের নেতৃত্বে সম্ভাব্য জোটের অন্যতম শরিক চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন। 

তারা ঘোষণা দিয়েছে ৩০০ আসনে বিজয়ের জন্যই লড়াই করবে। তাই তাদের মধ্যে আসন ভাগাভাগি নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। 

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা ভোটের জন্য জোটের কথা না বললেও ইসলামিক দলগুলোকে এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। 

শুভ কিবরিয়া বলেন, “জামায়াতকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখছে বিএনপি। ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে তারা শক্তিশালী জোট তৈরি করছে। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে ধর্মীয় ভাবাপন্নতার একটি উত্থান ঘটেছে।

“সাপ্রেশনের মধ্যে একমাত্র ধর্মীয় আদর্শের দলগুলোই বিকশিত হয়। ওই সিচুয়েশনকে ব্যবহার করে তারা বিকশিত হওয়ার স্পেস পায়। পৃথিবীর সব দেশেই তাই,” বলেন তিনি। 

সম্প্রতি ছাত্র সংসদ নির্বাচনের উদাহরণ দিয়ে শুভ কিবরিয়া বলেন, “গত ১৮ বছর কিন্তু ছাত্রদল-ছাত্রশিবির কোনোটিরই বিকশিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু ডাকসু, রাকসু, চাকসু নির্বাচনে শিবিরের প্যানেল জয়ী হয়েছে।”

তবে জামায়াতের ভোট কতটা বেড়েছে, তা নির্বাচনের ফলাফলের আগে বোঝা যাচ্ছে না বলেও মন্তব্য করেন এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। 

এনসিপির দুই সঙ্গী  

এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গঠিত গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট কীভাবে নির্বাচন পরিকল্পনা সাজাবে তা এখনো পরিষ্কার না। 

এনসিপিকে নিয়ে একাধিক গুঞ্জন উঠেছিল। প্রথমে বলা হচ্ছিল- তারা জামায়াতের সঙ্গে জোট করতে পারে। 

এরপর বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি নিয়েও প্রসঙ্গ আসে। গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গেও জোট হতে পারে বলে খবর বের হয়।

এই জোটটি নয়া বন্দোবস্তের রাজনৈতিক চিন্তা আছে বলে মনে করেন শুভ কিবরিয়া।

“কিন্তু তাদের সাংগঠনিক শক্তি, জনসমর্থন, ভোটের অংশ- খুব বড় উচ্চাশা পোষণ করার বাস্তবতা নেই।” 

জাপা ও জেপি

জি এম কাদেরের জাতীয় পার্টিকে ফ্যাসিবাদের দোসর আখ্যা দিয়ে নির্বাচনে নিষিদ্ধের দাবি জানিয়েছে জামায়াত ও এনসিপি।

তারা নিষিদ্ধ না হলেও এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচনি কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়।

তবে আনিসুল ইসলাম ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জোট ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন শুভ কিবরিয়া। 

তিনি বলেন, “তাদের এই জোট আওয়ামী লীগের লোকজনকে জায়গা দেওয়ার স্পেস ও ভারতীয় ইন্ধন আছে বলে অনেকে বলছেন। 

“এই জোটের ব্যানারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ লোক আছেন- যাদের ভোট আছে, টাকা আছে এবং আন্তর্জাতিক কানেকশন আছে।”

শুভ কিবরিয়া মনে করেন, এনসিপির জোট এবং জাপা ও জেপির জোটের একটা অংশের ভোটারদের ভাবধারা বিএনপির সঙ্গে মিলে যায়। এর ফলে বিএনপির জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে এই দুই জোট।