খুলনার যে আসনে কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, সেখানে অর্ধেকের বেশি ভোটার হিন্দু ধর্মের অনুসারী। অতীতে এই আসনটিতে বেশিরভাগ সময় সংখ্যালঘু প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।
নাহিদ হোসেন
প্রকাশ : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:৫৪ পিএমআপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০১:৫৫ পিএম
জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দিয়েছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরও তাই জায়গা দিচ্ছে দলটি।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়তে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দিয়েছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি।
প্রশ্ন উঠছে, এটি কি আসন্ন নির্বাচন কেন্দ্র করে দলটির রাজনৈতিক কৌশল, নাকি ধর্মভিত্তিক চর্চা থেকে সরে সবার দল হয়ে উঠতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী।
ফেব্রুয়ারিতে মুসলমান, ডিসেম্বরে হিন্দু
গত ৯ই ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলার ৬টি নির্বাচনি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। তখন দাকোপ-বটিয়াঘাটা নিয়ে গঠিত খুলনা-১ আসনে মনোনয়ন পান বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর শেখ আবু ইউসুফ। কিন্তু গত ৩রা ডিসেম্বর নতুন প্রার্থী হিসাবে কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
কৃষ্ণ নন্দী জামায়াতে ইসলামীর ডুমুরিয়া উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতি। তাকে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে কেন এই সিদ্ধান্ত? কী বার্তা দিতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী?
কী আছে জামায়াতের গঠনতন্ত্রে?
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে ১১ নাম্বার ধারায় লেখা আছে, “বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কর্মসূচির সহিত ঐকমত্য পোষণ করিলে তিনি জামায়াতের সহযোগী সদস্য হইতে পারিবেন।”
অমুসলিমদের কথা উল্লেখ করে ১২ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির সহিত একমত পোষণ করিলে বাংলাদেশের যে কোন অমুসলিম নাগরিক ইহার সহযোগী সদস্য/ সদস্য হইতে পারিবেন।”
যা বলছেন কৃষ্ণ নন্দী
মনোনয়ন পাওয়া কৃষ্ণ নন্দী বলেছেন, “জামায়াতে ইসলাম ইসলামি দল। তারপরেও তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে। তাই অন্য ধর্মের লোকদের নিয়ে তারা সরকার গঠন করবে।”
ভোটে জেতার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেছেন,“আমি একজন হিন্দু মানুষ, দাকোপ-বাটিয়াঘাটা থেকে আমাকে নমিনেশন দিয়েছে। এখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাকে গ্রহণ করবে।”
কৃষ্ণ নন্দীর মতে, জামায়াতে ইসলামী আগে সেভাবে নজর দিতো না, তবে এখন দলটি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে নিয়ে চলতে চায়। ২০০৩ সাল থেকেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত বলেও দাবি করেন তিনি।
কৌশল নাকি নীতি?
জামায়াত কি নীতি বদলেছে? নাকি আসন্ন নির্বাচনি কৌশল। এই প্রশ্ন করেছিলাম ঢাকা-১৪ আসনে জামায়াতের প্রার্থী মীর আহমাদ বিন কাসেম, যিনি ব্যারিস্টার আরমান নামেই পরিচিত।
তিনি বলছিলেন, “জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অমুসলিমদের সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বহু আগে থেকেই জামায়াতের অমুসলিম ইউনিট ছিল। এবং যারাই আমাদের সংগঠনের সাধারণ সদস্য তাদেরকে মনোনয়ন দেওয়ার গঠনতন্ত্রে একদম শুরু থেকেই সুযোগটা রয়েছে।”
কিন্তু এতদিন সুযোগ থাকার পরও এই চর্চা করতে দেখা যায়নি জামায়াতে ইসলামীকে। ব্যারিস্টার আরমান বলছিলেন, “এইবার প্রথমবারের মতো দেওয়া হচ্ছে কারণ এইবার জামায়াতে ইসলামী মাঠে নামছে শুধু কয়েকটি আসনের জন্য নয়। আটদল এবং আরো সমমনা কয়েকটি দলকে নিয়ে তারা মাঠে নামছে সরকার গঠন করার লক্ষ্যে।”
“সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরকে সাথে নিয়েই নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায় জামায়াতে ইসলামী”- বলছিলেন ব্যরিস্টার আরমান।
জামায়াতে ইসলামীর এই উদ্যোগকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসাবেই দেখছেন সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হাসান মামুন। তিনি বলছিলেন, “জামায়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ নির্বাচনে যে কৌশল নিয়েছিল ‘আদিবাসী’, নারী প্রার্থীকে সামনে এনে তারই একটা ধারাবাহিকতা মনে হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে। এই দুটি সমালোচনাতো ছিল জামায়াতের বিরুদ্ধে যে তারা এ বিষয়ে ইনক্লুসিভ না। এখন এটা নীতিগত না কৌশলগত তা ক্রমেই পরিষ্কার হবে।”
অর্ধেকের বেশি ভোটার হিন্দু
খুলনার যে আসনে কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেখানে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোটার হিন্দু ধর্মের অনুসারী। এ কারণেই মনোনয়ন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছিলেন, “না কৌশল না, এটা কোনও কৌশল না”।
এই আসনটিতে বেশিরভাগ সময় সংখ্যালঘু প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখনকার খুলনা-১ আসনটি ছিল খুলনা-৫। এই আসনে প্রথম এমপি হন কুবের চন্দ্র বিশ্বাস। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় পান প্রফুল্ল কুমার শীল।
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন প্রফুল্ল কুমার মণ্ডল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রথমে শেখ হাসিনা জিতলে আসনটি ছেড়ে দেন। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শেখ হারুনুর রশিদ, কিন্তু পঞ্চানন বিশ্বাসের কাছে হেরে যান। যদিও পঞ্চানন বিশ্বাস আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে শপথ নেন।
২০০১ সালে ফের জয়ী হন পঞ্চানন বিশ্বাস। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের ননী গোপাল মণ্ডল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আবারও এমপি হন পঞ্চানন বিশ্বাস। আর ২০২৪ সালে জয়ী হন ননী গোপাল মণ্ডল।
সরকার গঠন করতে চায় জামায়াত
ব্যারিস্টার আরমান বলছিলেন, “ইসলামী রাজনীতিতে সংখ্যালঘু মুসলমান নয়, সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করার নীতি ইসলামেরই নীতি। আমরা যেসব ইসলামিক রাষ্ট্রের ফর্মুলা ইসলামের স্বর্ণযুগে দেখেছি সেখানে অমুসলিমদের অংশগ্রহণ ছিল। এটা ইসলামি রাজনীতি থেকে সরে আসা নয়, বরং ইসলামি রাজনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ।”
ইসলামি নীতি বা শরিয়াহ ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের যে দীর্ঘদিনের চর্চা, জামায়াত সেই জায়গা থেকে সরে আসছে কি-না? প্রশ্ন ছিল ব্যারিস্টার আরমানের কাছে।
তিনি বলছিলেন, “জামায়াত সর্বশেষ ৩০০ আসনে নির্বাচন করেছিল ১৯৯৬ সালে। এরপর থেকে যেহেতু জোটের রাজনীতি ছিল, এজন্য সব আসনে জামায়াতের প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ ছিল না। অমুসলিমদের রাজনীতিতে সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা শরীয়তেই রয়েছে। তাই শরীয়তের রাজনীতি থেকে সরে আসা নয়, বরং শরীয়তের ভিত্তিতেই সবাইকে নিয়ে একটি ইনক্লুসিভ সমাজ এটা শরীয়তেরই অংশ।”
সিনিয়র সাংবাদিক হাসান মামুন বলছিলেন, “হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও একটা মনোভাবের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, তারা ফিল করছে যে ৫ই অগাস্টের পর একটা পরিবর্তন হয়েছে এবং এটার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে। অ্যাডজাস্টমেন্টটা হচ্ছে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঠিকাদারি নেওয়ার মতো দল থাকবে না, তারা পছন্দমত ভোট দেবে।”
জামায়াত কে ইসলামী ধর্মভিত্তিক দল উল্লেখ করে হাসান মামুন বলেন, “অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সাথে তাদের একটা পার্থক্য আছে। জামায়াত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে রাজনীতি করতে চায়। কোনও কোনও ইসলাম ঘনিষ্ট দল কিন্তু এই ধারাতে নাই।”
সরকার গঠন করতে চায় জামায়াত
ব্যারিস্টার আরমান বলছিলেন, “সব সময় জামায়াতের রাজনৈতিক ইচ্ছা ছিলো কয়েকটি আসনভিত্তিক। এটাই ম্যাক্সিমাম গোল ছিল। যেহেতু এবার সরকার গঠনের লক্ষ্যে জামায়াত মাঠে নামছে; সংখ্যালঘুদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সামগ্রিক ইসলামভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জামায়াত আগাচ্ছে।”
জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শ বিশ্বাস করেন কিনা? এমন প্রশ্নে কৃষ্ণ নন্দী বলছিলেন “করি করি, বিশ্বাস করি।” ওই চর্চার সাথে কোনো সংঘাত তৈরি হবে না মনে করেন তিনি। বলেছেন, “তাদের কাজ তারা করবে, আমার কাজ আমি করব। আমার কথা হলো জামায়াতে ইসলামী, ইসলামি দল ঠিক আছে। হিন্দুদের কথা বলার জন্যই আমাকে সংসদে নিয়ে যেতে চাচ্ছে তারা।”
হিন্দু হলো, বাকিদের কী হবে?
গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি জায়গায় জামায়াতে ইসলামীতে হিন্দু সম্প্রদায় যুক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ২০২৫ সালে তা বেড়েছে অনেকটাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে দলটিতে যোগ দিয়েছে হিন্দু সদস্য। কিন্তু হিন্দু ছাড়াও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে এখনও অবস্থান স্পষ্ট করেনি জামায়াত।
সাংবাদিক হাসান মামুন বলছিলেন, “এই যে কৌশলের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়কে যুক্ত করার, এর ভেতর দিয়ে গোটা বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে কিনা এটা কিন্তু একটা প্রশ্ন। গোটা বাংলাদেশ বলতে বোঝাচ্ছি যে, এখানে হিন্দুরা তো শুধু সংখ্যালঘু নয়, এখানে জাতিগত সংখ্যালঘু আছে। এমনকি নারীও সংখ্যালঘু মনে করা হয়। যদিও সংখ্যায় অর্ধেক কিন্তু ক্ষমতায়নের দিক থেকে দেখলে নারীতো সংখ্যালঘু। সেই জায়গায় জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি কী?”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এটা কমবে কিনা, এক্ষেত্রে জামায়াত কন্ট্রিবিউট করবে কিনা, এটা হচ্ছে মূল প্রশ্ন। এখানে দু’য়েকজন হিন্দু প্রার্থী এলো কি- না এলো এটা বড় বিষয় না। একাত্তর প্রশ্নে তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে কিনা। মব হচ্ছে, বাউলদের উপর অ্যাটাক হচ্ছে, তারাও তো সংখ্যালঘু। মাজারে যারা যায় তারা কি যেতে পারবে? এইসব বিষয়েও জামায়াতকে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে যদি সত্যি সত্যি তারা ইনক্লুসিভ সমাজ তৈরি করতে চায়।”
হিন্দু প্রার্থী: জামায়াতের নীতি বদল নাকি কৌশল
খুলনার যে আসনে কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী, সেখানে অর্ধেকের বেশি ভোটার হিন্দু ধর্মের অনুসারী। অতীতে এই আসনটিতে বেশিরভাগ সময় সংখ্যালঘু প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চর্চার খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদেরও তাই জায়গা দিচ্ছে দলটি।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লড়তে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিকে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দিয়েছে, যা অতীতে কখনও দেখা যায়নি।
প্রশ্ন উঠছে, এটি কি আসন্ন নির্বাচন কেন্দ্র করে দলটির রাজনৈতিক কৌশল, নাকি ধর্মভিত্তিক চর্চা থেকে সরে সবার দল হয়ে উঠতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী।
ফেব্রুয়ারিতে মুসলমান, ডিসেম্বরে হিন্দু
গত ৯ই ফেব্রুয়ারি খুলনা জেলার ৬টি নির্বাচনি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। তখন দাকোপ-বটিয়াঘাটা নিয়ে গঠিত খুলনা-১ আসনে মনোনয়ন পান বটিয়াঘাটা উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর শেখ আবু ইউসুফ। কিন্তু গত ৩রা ডিসেম্বর নতুন প্রার্থী হিসাবে কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
কৃষ্ণ নন্দী জামায়াতে ইসলামীর ডুমুরিয়া উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতি। তাকে মনোনয়ন দেওয়ার পর থেকেই প্রশ্ন উঠেছে কেন এই সিদ্ধান্ত? কী বার্তা দিতে চাইছে জামায়াতে ইসলামী?
কী আছে জামায়াতের গঠনতন্ত্রে?
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্রে ১১ নাম্বার ধারায় লেখা আছে, “বাংলাদেশের যে কোন নাগরিক বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য এবং কর্মসূচির সহিত ঐকমত্য পোষণ করিলে তিনি জামায়াতের সহযোগী সদস্য হইতে পারিবেন।”
অমুসলিমদের কথা উল্লেখ করে ১২ নাম্বার ধারায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচির সহিত একমত পোষণ করিলে বাংলাদেশের যে কোন অমুসলিম নাগরিক ইহার সহযোগী সদস্য/ সদস্য হইতে পারিবেন।”
যা বলছেন কৃষ্ণ নন্দী
মনোনয়ন পাওয়া কৃষ্ণ নন্দী বলেছেন, “জামায়াতে ইসলাম ইসলামি দল। তারপরেও তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস করে। তাই অন্য ধর্মের লোকদের নিয়ে তারা সরকার গঠন করবে।”
ভোটে জেতার আশা প্রকাশ করে তিনি বলেছেন,“আমি একজন হিন্দু মানুষ, দাকোপ-বাটিয়াঘাটা থেকে আমাকে নমিনেশন দিয়েছে। এখানে হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাকে গ্রহণ করবে।”
কৃষ্ণ নন্দীর মতে, জামায়াতে ইসলামী আগে সেভাবে নজর দিতো না, তবে এখন দলটি হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে নিয়ে চলতে চায়। ২০০৩ সাল থেকেই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত বলেও দাবি করেন তিনি।
কৌশল নাকি নীতি?
জামায়াত কি নীতি বদলেছে? নাকি আসন্ন নির্বাচনি কৌশল। এই প্রশ্ন করেছিলাম ঢাকা-১৪ আসনে জামায়াতের প্রার্থী মীর আহমাদ বিন কাসেম, যিনি ব্যারিস্টার আরমান নামেই পরিচিত।
তিনি বলছিলেন, “জামায়াতে ইসলামীর গঠনতন্ত্র অনুযায়ী অমুসলিমদের সদস্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বহু আগে থেকেই জামায়াতের অমুসলিম ইউনিট ছিল। এবং যারাই আমাদের সংগঠনের সাধারণ সদস্য তাদেরকে মনোনয়ন দেওয়ার গঠনতন্ত্রে একদম শুরু থেকেই সুযোগটা রয়েছে।”
কিন্তু এতদিন সুযোগ থাকার পরও এই চর্চা করতে দেখা যায়নি জামায়াতে ইসলামীকে। ব্যারিস্টার আরমান বলছিলেন, “এইবার প্রথমবারের মতো দেওয়া হচ্ছে কারণ এইবার জামায়াতে ইসলামী মাঠে নামছে শুধু কয়েকটি আসনের জন্য নয়। আটদল এবং আরো সমমনা কয়েকটি দলকে নিয়ে তারা মাঠে নামছে সরকার গঠন করার লক্ষ্যে।”
“সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আমাদের সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদেরকে সাথে নিয়েই নতুন বাংলাদেশ গড়তে চায় জামায়াতে ইসলামী”- বলছিলেন ব্যরিস্টার আরমান।
জামায়াতে ইসলামীর এই উদ্যোগকে তাৎপর্যপূর্ণ হিসাবেই দেখছেন সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হাসান মামুন। তিনি বলছিলেন, “জামায়াত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংসদ নির্বাচনে যে কৌশল নিয়েছিল ‘আদিবাসী’, নারী প্রার্থীকে সামনে এনে তারই একটা ধারাবাহিকতা মনে হচ্ছে জাতীয় পর্যায়ে। এই দুটি সমালোচনাতো ছিল জামায়াতের বিরুদ্ধে যে তারা এ বিষয়ে ইনক্লুসিভ না। এখন এটা নীতিগত না কৌশলগত তা ক্রমেই পরিষ্কার হবে।”
অর্ধেকের বেশি ভোটার হিন্দু
খুলনার যে আসনে কৃষ্ণ নন্দীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে সেখানে পঞ্চাশ শতাংশের বেশি ভোটার হিন্দু ধর্মের অনুসারী। এ কারণেই মনোনয়ন কি-না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলছিলেন, “না কৌশল না, এটা কোনও কৌশল না”।
এই আসনটিতে বেশিরভাগ সময় সংখ্যালঘু প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এখনকার খুলনা-১ আসনটি ছিল খুলনা-৫। এই আসনে প্রথম এমপি হন কুবের চন্দ্র বিশ্বাস। দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় পান প্রফুল্ল কুমার শীল।
১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন প্রফুল্ল কুমার মণ্ডল। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে প্রথমে শেখ হাসিনা জিতলে আসনটি ছেড়ে দেন। উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান শেখ হারুনুর রশিদ, কিন্তু পঞ্চানন বিশ্বাসের কাছে হেরে যান। যদিও পঞ্চানন বিশ্বাস আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে শপথ নেন।
২০০১ সালে ফের জয়ী হন পঞ্চানন বিশ্বাস। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগের ননী গোপাল মণ্ডল। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আবারও এমপি হন পঞ্চানন বিশ্বাস। আর ২০২৪ সালে জয়ী হন ননী গোপাল মণ্ডল।
সরকার গঠন করতে চায় জামায়াত
ব্যারিস্টার আরমান বলছিলেন, “ইসলামী রাজনীতিতে সংখ্যালঘু মুসলমান নয়, সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করার নীতি ইসলামেরই নীতি। আমরা যেসব ইসলামিক রাষ্ট্রের ফর্মুলা ইসলামের স্বর্ণযুগে দেখেছি সেখানে অমুসলিমদের অংশগ্রহণ ছিল। এটা ইসলামি রাজনীতি থেকে সরে আসা নয়, বরং ইসলামি রাজনীতির উৎকৃষ্ট উদাহরণ।”
ইসলামি নীতি বা শরিয়াহ ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের যে দীর্ঘদিনের চর্চা, জামায়াত সেই জায়গা থেকে সরে আসছে কি-না? প্রশ্ন ছিল ব্যারিস্টার আরমানের কাছে।
তিনি বলছিলেন, “জামায়াত সর্বশেষ ৩০০ আসনে নির্বাচন করেছিল ১৯৯৬ সালে। এরপর থেকে যেহেতু জোটের রাজনীতি ছিল, এজন্য সব আসনে জামায়াতের প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ ছিল না। অমুসলিমদের রাজনীতিতে সুযোগ দেওয়ার ব্যবস্থা শরীয়তেই রয়েছে। তাই শরীয়তের রাজনীতি থেকে সরে আসা নয়, বরং শরীয়তের ভিত্তিতেই সবাইকে নিয়ে একটি ইনক্লুসিভ সমাজ এটা শরীয়তেরই অংশ।”
সিনিয়র সাংবাদিক হাসান মামুন বলছিলেন, “হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেও একটা মনোভাবের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, তারা ফিল করছে যে ৫ই অগাস্টের পর একটা পরিবর্তন হয়েছে এবং এটার সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে। অ্যাডজাস্টমেন্টটা হচ্ছে যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঠিকাদারি নেওয়ার মতো দল থাকবে না, তারা পছন্দমত ভোট দেবে।”
জামায়াত কে ইসলামী ধর্মভিত্তিক দল উল্লেখ করে হাসান মামুন বলেন, “অন্যান্য ধর্মভিত্তিক দলের সাথে তাদের একটা পার্থক্য আছে। জামায়াত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়ে রাজনীতি করতে চায়। কোনও কোনও ইসলাম ঘনিষ্ট দল কিন্তু এই ধারাতে নাই।”
সরকার গঠন করতে চায় জামায়াত
ব্যারিস্টার আরমান বলছিলেন, “সব সময় জামায়াতের রাজনৈতিক ইচ্ছা ছিলো কয়েকটি আসনভিত্তিক। এটাই ম্যাক্সিমাম গোল ছিল। যেহেতু এবার সরকার গঠনের লক্ষ্যে জামায়াত মাঠে নামছে; সংখ্যালঘুদেরকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি সামগ্রিক ইসলামভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জামায়াত আগাচ্ছে।”
জামায়াতের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আদর্শ বিশ্বাস করেন কিনা? এমন প্রশ্নে কৃষ্ণ নন্দী বলছিলেন “করি করি, বিশ্বাস করি।” ওই চর্চার সাথে কোনো সংঘাত তৈরি হবে না মনে করেন তিনি। বলেছেন, “তাদের কাজ তারা করবে, আমার কাজ আমি করব। আমার কথা হলো জামায়াতে ইসলামী, ইসলামি দল ঠিক আছে। হিন্দুদের কথা বলার জন্যই আমাকে সংসদে নিয়ে যেতে চাচ্ছে তারা।”
হিন্দু হলো, বাকিদের কী হবে?
গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি জায়গায় জামায়াতে ইসলামীতে হিন্দু সম্প্রদায় যুক্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। ২০২৫ সালে তা বেড়েছে অনেকটাই। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুরে আনুষ্ঠানিকভাবে দলটিতে যোগ দিয়েছে হিন্দু সদস্য। কিন্তু হিন্দু ছাড়াও অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিয়ে এখনও অবস্থান স্পষ্ট করেনি জামায়াত।
সাংবাদিক হাসান মামুন বলছিলেন, “এই যে কৌশলের আশ্রয় নেয়া হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়কে যুক্ত করার, এর ভেতর দিয়ে গোটা বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে কিনা এটা কিন্তু একটা প্রশ্ন। গোটা বাংলাদেশ বলতে বোঝাচ্ছি যে, এখানে হিন্দুরা তো শুধু সংখ্যালঘু নয়, এখানে জাতিগত সংখ্যালঘু আছে। এমনকি নারীও সংখ্যালঘু মনে করা হয়। যদিও সংখ্যায় অর্ধেক কিন্তু ক্ষমতায়নের দিক থেকে দেখলে নারীতো সংখ্যালঘু। সেই জায়গায় জামায়াতের দৃষ্টিভঙ্গি কী?”
তিনি প্রশ্ন তোলেন, “রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এটা কমবে কিনা, এক্ষেত্রে জামায়াত কন্ট্রিবিউট করবে কিনা, এটা হচ্ছে মূল প্রশ্ন। এখানে দু’য়েকজন হিন্দু প্রার্থী এলো কি- না এলো এটা বড় বিষয় না। একাত্তর প্রশ্নে তারা তাদের অবস্থান পরিষ্কার করবে কিনা। মব হচ্ছে, বাউলদের উপর অ্যাটাক হচ্ছে, তারাও তো সংখ্যালঘু। মাজারে যারা যায় তারা কি যেতে পারবে? এইসব বিষয়েও জামায়াতকে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে যদি সত্যি সত্যি তারা ইনক্লুসিভ সমাজ তৈরি করতে চায়।”