এক সময় গণতন্ত্রকে বলা হতো মানবসভ্যতার সর্বোচ্চ অর্জন- যার মূল ভিত্তি হল স্বাধীনতা, অধিকার আর মতপ্রকাশের নিশ্চয়তা। সময়ের সাথে সাথে সেই গণতন্ত্র কি নিজের প্রাণ হারাতে বসেছে?
ভোট, সংবিধান ও নির্বাচন এখনো বর্তমান। কিন্তু গণতন্ত্রের প্রাণ- জবাবদিহি, স্বচ্ছতা ও নাগরিক স্বাধীনতা ক্রমেই কি ক্ষীণ হয়ে আসছে পৃথিবীজুড়ে?
যে ভোটবাক্স সাধারণ মানুষের ক্ষমতার প্রতীক ছিল, সেটাই এখন অনেক দেশে নাট্যমঞ্চে পরিণত হয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন। নির্বাচন হচ্ছে, ব্যালট পড়ছে, ফলাফল ঘোষণাও হচ্ছে- কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত আসলেই কি জনগণ নিচ্ছে? নাকি আগেই লিখে রাখা কোনো স্ক্রিপ্টের সার্থক মঞ্চায়ণ হচ্ছে? বিশ্বজুড়ে এই প্রশ্নটি গত দেড় দশক ধরে বারবার উচ্চারিত।
বিশ্বের নানা প্রান্তে নির্বাচনের কাঠামো থাকলেও এর আত্মা হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকেই বলছেন- এ কোনো দৃশ্যমান হত্যাকাণ্ড নয়। বরং আইন, তথ্য, নজরদারি ও প্রোপাগান্ডার সূক্ষ্ম ব্যবহারে এক নিঃশব্দ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে গণতন্ত্রকে।
আজকের পৃথিবীতে গণতন্ত্র কতটা মুক্ত? কতটা জীবন্ত? এই প্রশ্ন এখন কেবল গবেষণাগারের নয়, রাজপথেরও। নির্বাচিত শাসকরা অনেক দেশেই জনগণের নামে ক্ষমতা ব্যবহার করছেন জনগণেরই বিরুদ্ধে।
কোথাও ভোট পরিণত হচ্ছে বৈধতার মুখোশে। কোথাও উন্নয়নের নামে স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে মতপ্রকাশের অধিকার।
গবেষণার তথ্য বলছে- বিশ্বের সিংহভাগ মানুষ এখন বাস করছে এমন দেশে, যেখানে গণতন্ত্র অনুপস্থিত। কোথাও রাজতন্ত্র। কোথাও স্বৈরতন্ত্র। আবার কোথাও একদলীয় আধিপত্য।
শাসনব্যবস্থা নিয়ে নতুন নতুন শব্দ তৈরি হয়েছে- হাইব্রিড রেজিম, নব্য ফ্যাসিবাদ। অর্থাৎ এমন রাষ্ট্র- যেখানে ভোট হয়, সংবিধান আছে, কিন্তু নাগরিকের স্বাধীনতা সীমিত। বাংলাদেশও এই আলোচনার বাইরে নয়।
উন্নয়ন আর স্থিতিশীলতার গল্পের আড়ালে উঠছে প্রশ্ন- গণতন্ত্র কি টিকে আছে? নাকি সেটিও হয়ে পড়েছে এক সাজানো প্রদর্শনী?
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ফ্রিডম হাউস। তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এমন সব জনপ্রিয় নেতা ও গোষ্ঠীর হাতে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে গণতন্ত্র আক্রমণের মুখে পড়েছে- যারা বহুত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজ সমর্থকদের স্বার্থ রক্ষার নামে অবারিত ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়। আর এটা সাধারণত হয়ে থাকে সংখ্যালঘু ও ভিন্নমতাবলম্বীদের ক্ষতির বিনিময়ে।
বিশ্লেষণধর্মী এই প্রতিবেদনে গণতন্ত্রের অবক্ষয়ের যে গল্প উঠে এসেছে, সেখানে রয়েছে- যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ; তুরস্ক থেকে দক্ষিণ কোরিয়া এবং আফ্রিকা থেকে ইউরোপ- প্রায় সব মহাদেশের কথাই।
কীভাবে একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতিতে গণতন্ত্রের পরিসর সংকুচিত হচ্ছে, কোথায় কোথায় তার মুখোশ খসে পড়ছে, আর সাধারণ মানুষের জীবনে এর প্রভাব কতটা গভীর- থাকছে এসব প্রশ্নেরও জবাব।
নীরব ঘাতক হাঙ্গেরির ইলিবারেল গণতন্ত্র

মধ্য ইউরোপের ছোট এক দেশ হাঙ্গেরি। সেখানে ২০১০ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন সমসাময়িক রাজনীতির এক বিতর্কিত চরিত্র ভিক্টর ওরবান।
তিনি প্রেসিডেন্ট হয়েই ঘোষণা দিলেন, তার দেশে আগের মতো আর লিবারেল গণতন্ত্রে চলবে না। গড়ে তুলবেন ‘ইলিবারেল ডেমোক্রেসি’। এটি এমন এক শাসনব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব থাকবে সর্বোচ্চ। ব্যক্তিস্বাধীনতা হবে নিয়ন্ত্রিত।
ওরবানের মতে, ইলিবারেল গণতন্ত্র স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় না। তবে প্রধান নীতি হিসেবে উদারনৈতিক (লিবারেল) মতাদর্শকে প্রত্যাখ্যান করে। এটি এমন এক কর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা যেখানে ব্যক্তি স্বাধীনতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো সমাজ, জাতীয় স্বার্থ ও সমষ্টিগত পরিচয়।
হাঙ্গেরির শাসক মনে করেন, উদার গণতন্ত্র পশ্চিমাদের জন্য; যা মূলত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও বিমূর্ত স্বাধীনতার প্রতীক এবং এটা সমাজ ও জাতিকে দুর্বল করে দেয়।
তার মতে, পশ্চিমা গণতন্ত্রের অত্যধিক ব্যক্তিস্বাধীনতা এরইমধ্যে সমাজকে দুর্বল করে ফেলেছে। তাই এমন শাসনব্যবস্থা প্রয়োজন যা রক্ষা করবে সমাজ, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও জাতীয় সার্বভৌমত্ব।
ভিক্টর ওরবান ২০১৪ সালের এক ভাষণে বলেন, “আমরা এমন এক রাষ্ট্র গড়ছি যা লিবারেল নয়। উপরন্তু কর্মনির্ভর; পরিবার ও জাতিকেন্দ্রিক।”
ওই ভাষণে রাশিয়া, চীন ও তুর্কিকে উদাহরণ হিসেবেও টানেন তিনি।
২০১০ সালে ক্ষমতায় এসেই বিস্তৃত আইন প্রণয়ন করেন এই শাসক। তবে তার নীতির পূর্ণাঙ্গ প্রতিফলন ঘটে ২০১২ সালের পয়লা জানুয়ারি, হাঙ্গেরির জন্য নতুন সংবিধান তৈরির মাধ্যমে। নতুন সংবিধানে:
- হাঙ্গেরিকে ‘ঐতিহ্যবাহী খ্রিষ্টান রাষ্ট্র’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। স্বীকৃতি পায় কেবল মাত্র নিবন্ধিত ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো। ছোট ধর্মীয় সংগঠনগুলো স্বীকৃতি হারায়।
- বিবাহকে ‘একজন পুরুষ ও একজন নারীর মধ্যে সম্পর্ক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে সমলিঙ্গ বিবাহ ও অন্যান্য পারিবারিক কাঠামো বাদ পড়ে যায়।
- বিচার বিভাগ ও সাংবিধানিক আদালতের ক্ষমতা সীমিত করা হয়। এতে সাংবিধানিক আদালত অর্থনৈতিক ও বাজেট সংক্রান্ত বিষয়ে আগের মতো স্বাধীনভাবে রায় দিতে পারে না। বেড়ে যায় নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা।
- সংসদ সদস্যের সংখ্যা ৩৮৬ থেকে কমিয়ে ১৯৯ জন করা হয়। এমন এক নতুন নির্বাচনি ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়, যাতে ওরবানের দল ফিদেস সুবিধা পায়।
- সরকারনিয়ন্ত্রিত মিডিয়া কাউন্সিল গঠন করা হয়। এর মাধ্যমে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করা হয়।
- স্বল্পমাত্রায় সীমিত করা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা।
- সংবিধানে দেশটির নামও পরিবর্তন করা হয়। আগেকার ‘রিপাবলিক অব হাঙ্গেরি’ হয়ে যায় শুধু ‘হাঙ্গেরি’।
ইউরোপিয়ান কাউন্সিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন সংবিধানের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল, বিচার বিভাগ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সংকুচিত এবং ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করেছেন ভিক্টর ওরবান।
তবে, তার সমর্থকরা নতুন বন্দোবস্তের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে দাবি করছেন- এর মাধ্যমে হাঙ্গেরির ‘জাতীয় সার্বভৌমত্ব’ ও ‘খ্রিষ্টান ঐতিহ্য’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে।
সমালোচনার পরও ভিক্টর ওরবান ভোটে জিতেই চলেছেন, তাও আবার নিরঙ্কুশভাবে। ২০১০ সালের পর ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২২ এর নির্বাচনেও জয়ী হন তিনি।
প্রশ্ন উঠছে- তাহলে কি জনগণ সত্যিই তাকে চায়? নাকি গণতন্ত্রের খোলসে লুকিয়ে চলছে ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’?
বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের পতন কতটা এবং কেন?

আমেরিকা, ইউরোপসহ বিভিন্ন মহাদেশে গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য খারাপ হচ্ছে এবং এটা নির্ণয়ের সূচকগুলোতে রক্তক্ষরণ চলছে নিয়মিত।
বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের উন্নয়ন এবং অবস্থান নির্ণয়ে কাজ করে এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স বা সংক্ষেপে ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া।
একটি দেশে গণতন্ত্র আছে কিনা, তা বুঝতে হলে মূলত কয়েকটি সূচককে বিবেচনায় রাখতে হবে বলে মনে করে ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া। এগুলো হলো- প্রতিনিধিত্ব, আইনের শাসন, অধিকার ও অংশগ্রহণ।
মানে দেশে জনগণের প্রতিনিধিত্ব হচ্ছে কিনা, বিচার ব্যবস্থা কতটা স্বাধীন, মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে কিনা এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলোতে মানুষের অংশগ্রহণ কতটুকু?
ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়ার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- অন্তত একটি গণতান্ত্রিক সূচকের মান কমেছে গত বছর এমন দেশের সংখ্যা ছিল ৯৪টি। আর এটা শুধু নিম্ন বা মধ্যমানের গণতান্ত্রিক দেশে হয়েছে তা নয়। এই অবনতি লক্ষ্য করা গেছে উচ্চমানের গণতান্ত্রিক কিছু দেশেও। তবে কয়েকটি দেশ আবার মান বাড়াতে পেরেছে- এমন দেশের সংখ্যা ৫৫টি।
২০২৪ সালে বিশ্বেজুড়ে হওয়া ৭৪টি দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া। এই নির্বাচনগুলোর প্রতিনিধিত্বের সূচক গত ২০ বছরে সর্বনিম্ন ছিল বলে এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে তারা।
সংস্থাটি বলছে, সার্বিকভাবে বিশ্বে গণতন্ত্রের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম এশিয়ায়। আর গণতন্ত্রের অধঃপতনের সূচকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে আফ্রিকা। হার ৩৩ শতাংশ।
পাশাপাশি ইউরোপের দেশগুলোতেও গণতন্ত্রের উল্লেখযোগ্য পতন দেখা যাচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ২৫ শতাংশ নিয়ে আফ্রিকার পরেই দ্বিতীয় স্থানে আছে ইউরোপ।
গণতান্ত্রিক অধঃপতনের একটি কারণ হিসেবে ‘অভিবাসনকে’ দায়ী করেছে ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়া। বিশ্বের প্রায় ৩০ কোটি মানুষ অভিবাসী, মানে তারা থাকে দেশের বাইরে। তাই নিজেদের দেশের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তগুলোতে তাদের অংশগ্রহণ কতটুকু তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে এই রিপোর্টে।
গণমাধ্যমের শ্বাসরুদ্ধ অবস্থা

যে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা কমে, সেখানে গণতন্ত্রের সূচকও নীচে নামে। দুইয়ের সম্পর্ক একেবারে সরাসরি। কারণ, গণতন্ত্রের ভিত্তি তথ্য। আর অবাধ তথ্যপ্রবাহ নির্ভর করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর। কিন্তু সেই ভিত্তিই কি এখন কেঁপে উঠছে?
ইন্টারন্যাশনাল আইডিয়ার গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা গত ৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নীচে। বিশ্বজুড়ে ৪৩টি দেশে সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না, রয়েছেন ভয়ভীতির মধ্যে।
সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা আফগানিস্তান, বুরকিনা ফাসো ও মিয়ানমারের। এরপরেই রয়েছে শিল্পোন্নত দক্ষিণ কোরিয়া।
আর এশিয়ার দেশগুলোতে সরকারের ক্ষমতাশালী ব্যক্তি ও তাদের সমর্থকদের দ্বারা হয়রানি-নির্যাতন বেড়েছে। মানহানি মামলা, অনলাইন হয়রানি ও রাজনৈতিক চাপ এখন স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের হাইব্রিড রেজিম ও অন্যান্য

ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ডেমোক্রেসি ইনডেক্স গণতন্ত্রহীনতার সংকটকে আরও স্পষ্ট করেছে। তাদের ২০২৪ সালের সূচকে বিশ্বের দেশগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে। মূলত গণতন্ত্রের অবস্থার উপর নির্ভর করে ভাগগুলো হলো-
- পরিপূর্ণ গণতন্ত্র
- ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র
- হাইব্রিড গণতন্ত্র
- কর্তৃত্ববাদী শাসন
নামগুলো শুনেই বোঝা যায় এ ধরনের গণতন্ত্র বলতে এমন শাসনব্যবস্থা বোঝায়, যেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলেও বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হয় না। এই শ্রেণিবিন্যাস কেবল পরিসংখ্যান নয়; এটি বিশ্বের রাজনৈতিক বাস্তবতার এক গভীর প্রতিচ্ছবি বলে মনে করা হয়।
তবে ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র ও হাইব্রিড গণতন্ত্র- এ দুটির অর্থ প্রায় এক হলেও দুটি ভাগ কেন হলো? পার্থক্য কোথায়?
ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র: কাঠামো আছে, আত্মা নেই
ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের ধারণা এসেছে জার্মান রাজনৈতিক বিজ্ঞানী আউরেল কোয়াসান ও ওলফগ্যাং মারকেলের গবেষণা থেকে। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দুই অধ্যাপক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যার বিষয়- ডিফেকটিভ বা ফ্লড ডেমোক্রেসি। বাংলায় যা ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’।
তাদের মতে, গণতন্ত্রের অস্তিত্ব কেবল নির্বাচন বা সাংবিধানিক কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। একটি কার্যকর গণতন্ত্র গড়ে ওঠে কয়েকটি স্তম্ভের উপর। যেমন নির্বাচনি ব্যবস্থা, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার, প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা ও নির্বাচিত সরকারের কার্যকর ক্ষমতা।
যখন এই উপাদানগুলোর একটি বা একাধিক দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন গণতন্ত্র থাকে বটে, কিন্তু সেটি ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে বলে ইকনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট মনে করে।
ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রে নির্বাচন হয়, বিরোধীদল থাকে, কিন্তু রাষ্ট্রযন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়, নাগরিক সমাজ দুর্বল হয়, আর জনগণের মত প্রকাশ সীমিত হয়ে পড়ে।
হাইব্রিড গণতন্ত্র: উন্নয়নের বয়ান

ত্রুটিপূর্ণ শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যগুলো দুর্বল হলেও তা উপস্থিত থাকে। তবে হাইব্রিড শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অনেক মূল বৈশিষ্ট্যই থাকে অনুপস্থিত। আর এটা ঢাকার জন্য গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নতুনভাবে দেওয়া হয়।
তাই হাইব্রিড গণতন্ত্রকে বলা হয় এক রাজনৈতিক বিভ্রম, যেখানে গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক কাঠামো আছে, কিন্তু কার্যত তা এক কর্তৃত্ববাদী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অধীন।
এখানে নির্বাচন হয়, তবে প্রতিযোগিতামূলক নয়। মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে, তবে শর্তযুক্ত। বিচারব্যবস্থা থাকে, কিন্তু সরকারের ছায়ার বাইরে নয়।
এই শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো- গণতন্ত্রের বিকল্প হিসেবে দাঁড় করানো হয় উন্নয়নকে। সরকার দাবি করে- অবকাঠামোগত অগ্রগতি, দারিদ্র্য হ্রাস বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গণতান্ত্রিক ঘাটতিকে পূরণ করতে পারে।
ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ২০২৪ সালের গণতন্ত্র সূচকে বাংলাদেশকে হাইব্রিড গণতন্ত্রের আওতায় রাখে। এই সূচকে ভুটান, ফিজি, হংকং, নেপালসহ আরও অনেক দেশের গণতন্ত্রকে হাইব্রিড বলে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে নির্বাচনপদ্ধতির স্বচ্ছতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা কমেছে। বিরোধী রাজনৈতিক কার্যক্রমের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে।
২০২৪-এর অগাস্টে পতনের আগে আওয়ামী লীগ সরকারও হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবানের মতো এক নতুন গণতন্ত্রের কথা বলতো- তা হলো উন্নয়নের গণতন্ত্র। যেখানে সরকার দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নকেই প্রাধান্য দেয়। কিন্তু গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্যগুলোকে অবজ্ঞা করা হয়। নিত্যনতুন বয়ান হাজির করে গণতন্ত্রের মৌলিক বিষয়গুলো অস্বীকার করা হয়। মোদ্দা কথা হলো সরকার ও তার সমর্থকগোষ্ঠীর নিজেদের গল্পের বাইরের কিছুতেই মাথাব্যথা থাকে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে দেশের গণতন্ত্র ক্রমেই রূপ নিয়েছে উন্নয়নের গণতন্ত্রে- যেখানে অবকাঠামোগত অগ্রগতি আছে, কিন্তু রাজনৈতিক অংশগ্রহণের পরিসর সংকুচিত।
বৈশ্বিক প্রবণতা: গণতন্ত্রের ঘাটতি, স্বৈরাচারের উত্থান

ইকনমিস্টের ২০২৪ সালের তথ্য বলছে- বিশ্বের ৭২ শতাংশ মানুষ রয়েছে কোনো না কোনো ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে। এরমধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বসবাস করছে সম্পূর্ণ স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে। আর পরিপূর্ণ গণতন্ত্রে রয়েছে মাত্র ছয় দশমিক ছয় শতাংশ মানুষ।
এদিকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তুলনায় স্বৈরাচারের সংখ্যা বাড়ছে। গণতন্ত্র নিয়ে কাজ করা ভি-ডেম ইনস্টিটিউটের তথ্য বলছে, গত দুই দশকের মধ্যে বিশ্বে স্বৈরাচারী রাষ্ট্রের সংখ্যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তুলনায় বেশি বেড়েছে।
চীন, রাশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান, সুদান ও মিয়ানমারের মতো দেশগুলো এখন শক্ত হাতে কর্তৃত্ববাদী শাসন বজায় রাখছে। সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ আজও কর্তৃত্ববাদী রাজনীতির দুর্গ।
বিশ্বে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নামে মূল্যবোধের যে কাঠামো ছিল, সেই কাঠামোর ভেতরটা এখন ফাঁপা হয়ে সেখানে ত্রুটিপূর্ণ বা হাইব্রিড ব্যবস্থা জন্ম নিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বাংলাদেশ, হাঙ্গেরি বা তুরস্কের মতো দেশগুলো এই রূপান্তরের প্রতীক, যেখানে নির্বাচন আছে, উন্নয়ন আছে। কিন্তু বিরোধী কণ্ঠ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর জায়গা ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে।
আর এই ধরণের স্বৈরতন্ত্রের কৌশলও বদলেছে। এক সময় ট্যাংক ও বন্দুক দিয়ে যা করা হতো, এখন তা হয় আইন, তথ্যপ্রযুক্তি ও প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে।
রাজনৈতিক তাত্ত্বিকরা একে বলেন, ডিজিটাল অটোক্রেসি। যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া ও তথ্যযুদ্ধের মাধ্যমে মানুষের মতামত নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এথেন্স থেকে দীর্ঘ যাত্রা

গণতন্ত্রের ইতিহাস প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে এথেন্সে জন্ম নেয় জনগণের শাসন। কিন্তু সেই গণতন্ত্র সবার ছিল না। কেবল ধনী ও পুরুষ নাগরিকরাই ভোট দিতে পারতেন। নারী, দাস ও বিদেশিরা ছিলেন বঞ্চিত।
এখানেই জন্ম নেয় ডাইরেক্ট ডেমোক্রেসি বা সরাসরি গণতন্ত্র। যেখানে নাগরিকরাই সিদ্ধান্ত নিতেন আইন ও প্রশাসনিক বিষয়ে।
মধ্যযুগে চার্চ ও রাজতন্ত্র এই ধারা থামিয়ে দেয়। কিন্তু ১২১৫ সালে ইংল্যান্ডের ম্যাগনাকার্টা প্রথমবার রাজশক্তির সীমা টেনে দেয়। গণতন্ত্রের ভিত্তি সেখান থেকেই।
ম্যাগনাকার্টা সনদ ছিল- রাজতন্ত্র থেকে আইনের শাসনে উত্তরণের পদক্ষেপ। যেটিকে আধুনিক ব্রিটিশ সংবিধানের ভিত্তি ধরা হয়।
১১৯৯ সালে ইংল্যান্ডের সিংহাসনে বসেন রাজা জন প্ল্যান্টাজেনেট, যিনি ছিলেন অত্যন্ত অজনপ্রিয়। যুদ্ধ, করের বোঝা আর দুর্নীতিতে দেশের অবস্থা শোচনীয় হয়ে ওঠে। আদালতের ন্যায়বিচার পেতেও লাগতো টাকা। তখন চুক্তিতে বাধ্য হন রাজা।
১২১৫ সালের পনেরোই জুন ম্যাগনাকার্টা চুক্তি হয়। সনদের মূল বার্তা ছিল- রাজাসহ কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি, একচ্ছত্র রাজক্ষমতার অবসান ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা।
এই সনদ থেকেই পশ্চিমা বিশ্বের আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের সূচনা ঘটে।
এরপর আসে আমেরিকান বিপ্লব (১৭৬৫–১৭৮৩) এবং ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯) যেখানে মানুষের স্বাধীনতা ও প্রতিনিধিত্বের ধারণা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়।
ফরাসি বিপ্লবের ‘স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব’ পরবর্তীতে আধুনিক গণতন্ত্রের মূলে জায়গা নেয়। বিশ শতকের দুই বিশ্বযুদ্ধ গণতন্ত্রকে একদিকে দুর্বল, আবার অন্যদিকে শক্তিশালী করে।
নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও কমিউনিজমের উত্থান গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছিল। কিন্তু সেই লড়াই থেকেই উঠে এসেছে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক নীতির নতুন নতুন অধ্যায়।
সামরিক উত্থান: গণতন্ত্রের চিরশত্রু
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত শতাধিক দেশে ২০০ বারেরও বেশি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। থাইল্যান্ড, পাকিস্তান, মিশর, বাংলাদেশ, আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, নিজার- প্রতিটি দেশেই সেনাবাহিনী কখনো সরাসরি, কখনো আড়ালে থেকে ক্ষমতা দখল করেছে।
মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ইতিহাস উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। ২০২১ সালে ভোট জালিয়াতির অভিযোগে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেয়। গৃহবন্দি করা হয় অং সান সুচিকে। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে দমননীতি।
এই সামরিক উত্থানগুলো শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়। এগুলো গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর মানুষের আস্থা ভেঙে দেয়, যা পরে বহু বছরেও পুনর্গঠিত হয় না।
যুক্তরাষ্ট্র কি ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের দিকে?

১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগান বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র হলো বিশ্ব গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা। কিন্তু আজ সেই আলো ম্লান বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যুক্তরাষ্ট্রকে ২০২৪ সালে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ গণতন্ত্রের আওতায় ফেলে। এর কারণ হলো, ২০২১ সালের ক্যাপিটল হিল দাঙ্গা, নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থার ঘাটতি, রাজনৈতিক মেরূকরণ ও বিভাজন। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র এখন আগের চেয়ে দুর্বল।
ডেমোক্রেটিক ইরোসন কনসর্টিয়াম বলছে, ২০০৭ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সূচক নেমে যেতে শুরু করে। সেখানকার ৩২ শতাংশ মানুষ মনে করে, ‘কঠোর কর্তৃত্ববাদই দেশের স্থিতিশীলতা আনতে পারে।’
আপনার বিশ্বাস নাও হতে পারে, কিন্তু প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের কিছু বক্তব্য দেখলেই মনে হতে পারে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের সরকারপ্রধানেরাও কখনো কখনো গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন।
ডনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালে যখন প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য প্রচারণা চালাচ্ছিলেন তখন কয়েকবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে “একজন খুব শক্তিশালী নেতা” হিসেবে বর্ণনা করেন। এবং পরবর্তী চার বছরের শাসনামলে তিনি বারবার এই রেফারেন্স দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায় তিনি এও বলেছেন ‘দেশের ওপর তার (পুতিনের) খুব শক্ত নিয়ন্ত্রণ রয়েছে”।
২০১৭ সালে ফক্স নিউজকে সাক্ষাৎকার দেবার সময় উপস্থাপক বিল ও’রেইলি যখন পুতিনকে “খুনী” বলে উল্লেখ করেন তখন ডনাল্ড ট্রাম্প জবাবে বলেছিলেন, “অনেক খুনী আছে। আমাদের এখানেও অনেক খুনী আছে। আপনি কী মনে করেন? আমাদের দেশ কি খুব নিষ্পাপ?”
সিএনএন এক নিবন্ধে একবার উল্লেখ করেছিল, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নানা বক্তৃতায় ও সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া পোস্টে অন্তত আশি বার প্রেসিডেন্ট পুতিনের নাম উল্লেখ করেছেন ডনাল্ড ট্রাম্প। বেশিরভাগই ছিল প্রশংসাসূচক।
গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক হিসেবে পরিচিত একটি দেশের নেতা, যিনি পরবর্তীতে দুইবার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তিনি যখন ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বের প্রশংসা করেন বারবার, তখন সেটাকে কেউ যদি গণতন্ত্রের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করার সমতুল্য বলে মনে করে, তাকে নিশ্চয়ই দোষ দেয়া যাবে না।
এমন অভিযোগও একবার উঠেছিল যে প্রথমবার নির্বাচিত হবার সময় প্রচারণার ক্ষেত্রে রাশিয়ার সহযোগিতা পেয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
ডেমোক্রেটিক ইরোসনে গত জুনে প্রকাশিত হয়েছে গবেষণাধর্মী একটি প্রতিবেদন যার শিরোনাম ‘অভ্যন্তরীণ আগুন: আমেরিকান গণতন্ত্র কি মরে যাচ্ছে?’
লেখক নিকিরিয়া ডোরসি শুরু করেছেন একটি বিখ্যাত উক্তি দিয়ে- “এমন কোনো গণতন্ত্র জন্মায়নি যা আত্মঘাতী হয়নি।”
“বিশ্বের সাম্রাজ্যগুলো গড়ে ২৫০ বছর বয়সে পতিত হয়েছে এবং আমেরিকার গণতন্ত্র ২৪৮ বছর বয়সী। তাহলে কি আমরা বলতে পারি যে, গণতন্ত্রের মৃত্যু পূর্বনির্ধারিত এবং স্বৈরশাসনের উত্থান অবশ্যম্ভাবী?” প্রশ্ন তুলেছেন ডোরসি।
তিনি লিখেছেন, “যখন আমেরিকায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে, তখন আমরা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ হিসেবে, দুই দলীয় ব্যবস্থার মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাবের লড়াই এবং রাজনৈতিক কাঠামোর ধ্বংস প্রক্রিয়াকে নীরবে দেখছি।
“মৃত্যু বললে আমরা সাধারণত তাৎক্ষণিক ধ্বংসকেই ভাবি। কিন্তু গণতন্ত্র ধীরে ধীরে মারা যায়- গণতান্ত্রিক নীতিমালা দুর্বল হওয়ার মাধ্যমে।”
নিকিরিয়া ডোরসি আরও লিখেছেন, “আমেরিকায় এ ব্যাপারে অনেক সতর্কবার্তা দেখা যাচ্ছে- রাজনৈতিক মেরুকরণ বৃদ্ধি, বিচার ব্যবস্থার পর্যালোচনা ক্ষমতা হ্রাস এবং ধীরগতিতে স্বৈরশাসক উত্থানের প্রবণতা।
ভারত: বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র, কিন্তু কতটা সুস্থ?

ভারতকে বর্ণনা করা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনি গণতন্ত্র বজায় রেখেছে দেশটি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রশ্ন উঠেছে এই গণতন্ত্র কতটা কার্যকর?
ভি-ডেম ইনস্টিটিউট ২০২৪ সালে ভারতকে বর্ণনা করেছে ‘ইলেক্টোরাল অটোক্রেসি’- অর্থাৎ এমন শাসনব্যবস্থা, যেখানে নির্বাচন আছে, কিন্তু প্রতিযোগিতা সীমিত।
কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করছে, নির্বাহী বিভাগের অতিরিক্ত ক্ষমতা, বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের ওপর প্রভাব, বিরোধী দল ও সাংবাদিকদের ওপর আইনি চাপ এবং ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি।
ফ্রিডম হাউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের গণতন্ত্রও এখন ‘হাইব্রিড’ অবস্থায় রয়েছে- যেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান টিকে আছে, কিন্তু স্বাধীনতা ক্রমশই ম্রিয়মাণ।
জার্নাল অব ডেমোক্রেসিতে ‘ভারতের গণতন্ত্রের অতিরঞ্জিত মৃত্যু’ নামে একটি গবেষণাধর্মী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যেটি লিখেছেন দিল্লির শীর্ষস্থানীয় থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের ফেলো অধ্যাপক রাহুল ভার্মা।
তিনি লিখেছেন, “গণতন্ত্র পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারতের গণতন্ত্রকে ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র’ ও ‘নির্বাচনী স্বৈরতন্ত্র’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিজেপির নেতৃত্বে ভারতের রাজনৈতিক কাঠামো জোটনির্ভর ব্যবস্থা থেকে ক্রমে বিজেপি-প্রভাবিত একক আধিপত্যের ব্যবস্থায় রূপ নিয়েছে।
“এই ব্যবস্থায় ভোটার উপস্থিতি বেড়েছে বটে, কিন্তু দলীয় নিয়ন্ত্রণ আরও কেন্দ্রীভূত হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক অবিশ্বাস বৃদ্ধি পেয়েছে, মেরুকরণ তীব্র হয়েছে এবং রাস্তায় বিক্ষোভের প্রবণতা বেড়েছে।”
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রাহুল ভার্মা লিখেছেন, “অনেকে বিজেপির শাসনকে দক্ষিণপন্থী জনতাবাদ বা রাইট-উইং পপুলিজম হিসেবে দেখছেন। তবুও নাগরিকদের একটি বড় অংশ এখনো গণতন্ত্র নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন। ভারতের বিশেষ রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতা তাই বিজেপি শাসনের অধীনে গণতন্ত্রের চ্যালেঞ্জগুলো বোঝার জন্য নতুন এক বিশ্লেষণ কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
“যখন জাতীয়তাবাদী-জনতাবাদী নেতারা নিজেদের আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশের রাজনীতিকে পুনর্গঠিত করছেন, তখন মতবিরোধ ও ভিন্নমতের সীমারেখা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে,” মন্তব্য করেছেন এই গবেষক।
জরুরি অবস্থা নিয়ে নিয়মিত লেখালেখি করেন ভারতের এম জি দেবসাহায়ম- যিনি গত জুন মাসে দ্য ওয়্যার-এ ‘জরুরি অবস্থার পঞ্চাশ বছর পর, নেতৃত্বের শূন্যতায় মৃত্যুপথে ভারতের গণতন্ত্র’ শীর্ষক একটি বিশ্লেষন লিখেছেন।
তিনি ভারতের বর্তমান গণতান্ত্রিক অবস্থাকে ‘জরুরি অবস্থার; সঙ্গে তুলনা করেছেন। লিখেছেন, “সমালোচকদের মতে, যদি মোদি সরকার সত্যিই গণতন্ত্র ও সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতো, তাহলে তারা জরুরি অবস্থার মতো শাসনব্যবস্থা চালাতো না।
“তাদের শাসনপদ্ধতির ধরণই প্রমাণ করে, ফ্যাসিবাদী প্রবণতা এখন ভারতের শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।”
এম জি দেবসাহায়ম আরও লিখেছেন, “তবে গত এক দশকে গণতন্ত্রকে যেভাবে দুর্বল করে তোলা হয়েছে, তা নিয়ে কোনো অনুশোচনা বা আত্মসমালোচনা না করেই বর্তমান শাসকগোষ্ঠী নিজেদেরকে ‘গণতন্ত্রের একমাত্র ও প্রকৃত অভিভাবক’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।”
মানুষের আস্থা কমছে

ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বৈশ্বিক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের ৫৮ শতাংশ মানুষ গণতন্ত্রে অসন্তুষ্ট। তাদের প্রধান অভিযোগ- রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কথা শোনে না, দুর্নীতি ও বৈষম্য বেড়েছে এবং রাজনীতি হয়ে পড়েছে এলিট শ্রেণির খেলা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণতন্ত্রের এই ‘নীরব মৃত্যু’ হচ্ছে মূলত তিনটি কারণে। এগুলো হলো- অর্থনৈতিক বৈষম্য, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ভেঙে পড়া এবং তথ্য যুদ্ধ ও ভুল তথ্যের বিস্তার।
তবে সব দেশই যে অন্ধকারে, বিষয়টি তেমন না। ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, কানাডার মত দেশ এখনো পূর্ণ গণতন্ত্রের তালিকায় রয়েছে। তাদের সাফল্যের রহস্য- শিক্ষা ও নাগরিক সচেতনতা, মুক্ত সংবাদমাধ্যম, আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা, সামাজিক সমতা ও স্বচ্ছ প্রশাসন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণতন্ত্রকে বাঁচাতে হলে নাগরিকদের ফের সক্রিয় হতে হবে। ভোট দেওয়া ছাড়াও মত প্রকাশ, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ এবং জবাবদিহিতার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে।
হাঙ্গেরি থেকে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ- সবখানেই প্রশ্ন উঠছে স্বাধীনতা, ন্যায়ভিত্তিক শাসন ও অংশগ্রহণ নিয়ে।। স্বাধীন বিশ্ববাসীও সম্ভবত সেই পুনর্জন্মের প্রান্তে দাঁড়িয়ে, যেখানে মানুষ আবার ভাবছে- ‘আমার কণ্ঠ কোথায়? আমার ভোটের মূল্য কত?’
ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবী যে নতুন একটি শাসনব্যবস্থার স্বাদ আস্বাদন করেছিলো, প্রায় ৩০০ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে তা ফিকে হতে বসেছে লোভী ও ক্ষমতাপাগল শাসকদের হাত ধরে। গণতন্ত্রে জনগণ সর্বোচ্চ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী এবং রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে সকল প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে।
এই সময়ে এসে দেখা যাচ্ছে, জনগণের নামে বিভিন্ন কৌশল বা ফন্দি-ফিকিরের মাধ্যমে জনগণকে অবরুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। সীমারেখা অতিক্রম করলে কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী দেয়। জনগণ কাউকে ছাড়ে না। শাসক মরে, কৌশল মার খায় কিন্তু জনগণ সার্বভৌম শক্তি হিসেবে টিকে থাকে সকল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে।
জনগণ টিকে থাকে বলেই গণতন্ত্র কখনো একবারে মরে না। এটি বারবার আঘাত পায়, জেগে ওঠে।



