ইতিহাসের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের চলতি টানাপোড়েন মূল্যায়ন করেছে ভারতের লোকসভার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটি। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঐকমত্য দুর্বল হওয়া, নতুন রাজনৈতিক শক্তি, উগ্রপন্থিদের উত্থান এবং চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে এসব পুনঃসমন্বয় না করতে পারলে ঢাকায় দিল্লি তার কৌশলগত অবস্থান হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে।

আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৪ পিএম

বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে বারবারই বলা হয়েছে ভারতের সাথে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুসম্পর্ক চায় ঢাকা।

ভারতও বারবার বলেছে, প্রতিবেশী প্রথম নীতিতে বাংলাদেশকে গুরুত্বের সাথে দেখে দিল্লি। সেই মাপকাঠিতেই সম্পর্ক এগিয়ে নিতে চায় তারা।

কিন্তু বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। দুই দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের ‘পলিটিকাল রেটোরিক’ প্রায়ই হয়ে উঠেছে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বাধা।

পাঁচই অগাস্ট পরবর্তী বাস্তবতায় অবশ্য শুধু কথার কথায় থাকেনি ওই ’পলিটিকাল রেটোরিক’। দুই সরকারের ‘সুসম্পর্কের’ প্রত্যাশার বাতাবরণেই চলেছে কথার বাহাস।

রাজনৈতিক যোগাযোগহীনতা প্রকটভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে কূটনীতি আর বাণিজ্যমঞ্চে।

ঢাকা-দিল্লিতে হাইকমিশনমুখী বিক্ষোভ

শনিবার রাতে দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আসে একদল ব্যক্তি।  ‘অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্রসেনা’র ব্যানারে তারা প্রায় ২০ মিনিট ধরে বাংলাদেশ হাউসের সামনে থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেয়।

আগের দিন শুক্রবার প্রায় একই ঘটনা ঘটে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের সামনে। সেখানে বিক্ষোভ করেছে স্থানীয় রাজনৈতিক দল টিপরা মোথা পার্টির যুব শাখা।

দুটি বিক্ষোভই হয়েছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এবং সেভেন সিস্টার্স নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক মন্তব্যের প্রতিবাদে।

শুক্রবার ভারতের ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ করেছ স্থানীয় রাজনৈতিক দল টিপরা মোথা পার্টির যুব শাখা।

এর আগে ১৭ই ডিসেম্বর বুধবার ঢাকায় মিছিল ও বিক্ষোভ হয়েছে জুলাই ঐক্যের ডাকে। শাহবাগ থেকে বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশনমুখী মিছিলটি বাড্ডায় আটকে দেয় পুলিশ।

ওই দিন নিরাপত্তা শঙ্কায় যমুনা ফিউচার পার্কের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্রের কার্যক্রম দুপুরে বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরদিন ফের চালু হয়।

১৮ই ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাজশাহীতে মার্চ টু ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন কর্মসূচির ডাক দেয় জুলাই ৩৬ মঞ্চ। মাঝপথে মিছিল আটকে দেয় পুলিশ।

খুলনায়ও বৃহস্পতিবার মার্চ টু ভারতীয় সহকারী হাইকমিশন কর্মসূচি পালন করে আধিপত্যবিরোধী ঐক্যজোট। পুলিশের বাধা পেয়ে রয়েল মোড়ে সমাবেশ করে তারা।

ওইদিন চট্টগ্রামেও বিক্ষোভ মিছিল হয় ভারতের সহকারী হাইকমিশনের সামনে। মধ্যরাতে হামলার চেষ্টা হয় সহকারী হাইকমিশনারের বাসায়। তবে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়।

মিছিলগুলোতে ভারতবিরোধী স্লোগান দেওয়া হয়। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার প্রতিবাদ এবং ওসমান হাদির হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজনের ভারত পালিয়ে যাওয়ার খবরে বিক্ষোভ করে সংগঠন ও প্ল্যাটফর্মগুলো।

রবিবার সকালে চট্টগ্রামের ভারতীয় ভিসা আবেদন কেন্দ্র পরবর্তী ঘোষণা না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তাদের ওয়েবসাইটের নোটিশে জানানো হয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় এই সিদ্ধান্ত।

যা বলছে দুই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়

দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে হওয়া বিক্ষোভ নিয়ে কার্যত পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছে সাউথ ব্লক ও সেগুনবাগিচা।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভের ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের কিছু গণমাধ্যমে ‘প্রোপাগান্ডা’ চালানো হচ্ছে।

বিবৃতিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, শনিবার ২০-২৫ জন হাইকমিশনের সামনে জড়ো হয়ে ময়মনসিংহে দিপু চন্দ্র দাসের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে স্লোগান দেয় এবং বাংলাদেশে সকল সংখ্যালঘুদের সুরক্ষার দাবি জানায়।

তবে কূটনৈতিক এলাকায় হওয়ার পরও বিক্ষোভকারীরা কেন সেখানে যেতে পারল সেই প্রশ্ন তুলছে ঢাকা।

১৭ই ডিসেম্বর বুধবার ঢাকায় জুলাই ঐক্যের ডাকে বারিধারায় ভারতীয় হাইকমিশনমুখী মিছিলটি বাড্ডায় আটকে দেয় পুলিশ।

রবিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন, “তারা বলছে ২০-২৫ জনের দল। হিন্দু চরমপন্থী ২৫ বা ৩০ জনের একটা দল এত দূর পর্যন্ত আসতে পারবে কেন এমন একটা সেনসিটিভ এলাকার মধ্যে?” প্রশ্ন তোলেন তৌহিদ হোসেন।

তাদের আসতে দেওয়া হয়েছে কি-না প্রশ্ন তুলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “নরমালি তাদের আসতে পারার কথা না।”

এই বিক্ষোভে কোনও নিরাপত্তা সংকট হয়নি বলে দাবি ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। বিবৃতিতে তারা বলেছে, “বিক্ষোভের সময় কোনো অবস্থাতেই হাইকমিশনের সীমানা প্রাচীর ভাঙার চেষ্টা বা নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় এমন কোন ঘটনা ঘটেনি। সেখানে দায়িত্বরত পুলিশ কয়েক মিনিটের মধ্যেই বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।”

দিল্লিতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার ও তার পরিবার ঝুঁকিবোধ করছে জানিয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, “আমার কাছে প্রমাণ নেই। কিন্তু আমরা শুনেছি যে তাকে (বাংলাদেশের হাইকমিশনার) হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সেখানে এসে তাকে হুমকি দেবে কেন?”

জুলাই আন্দোলনের সময় থেকেই বন্ধ আছে ভারতের পর্যটক ভিসা, তবে চিকিৎসাসহ অন্যান্যা ক্যাটাগরির ভিসা চালু আছে।

সম্পর্ক বিশ্লেষণ করেছে ভারতের সংসদীয় কমিটি

ভারতের লোকসভার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটি ২০২৪-২০২৫ সালের জন্য বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছে। এই কমিটির প্রধান কংগ্রেসের সংসদ সদস্য শশী থারুর।

গত ১৮ই ডিসেম্বর ‘ফিউচার অব ইন্ডিয়া বাংলাদেশ রিলেশনশিপ’ শিরোনামের রিপোর্টটি লোকসভা ও রাজ্যসভায় উত্থাপন করেছে। এতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব, সাবেক কূটনীতিক ও বিভিন্ন বিশ্লেষকের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে।

কমিটির রিপোর্ট বলছে, ২০২৪ সালের অগাস্টে পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ভারতের জন্য উদ্বেগ তৈরি করেছে।

বিশেষজ্ঞরা ভারতের সংসদীয় কমিটিকে বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতি ১৯৭১ সালের পর ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ।

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা মাথায় রেখে পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবস্থান উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে।

ভারতের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব

প্রতিবেদনের শুরুতেই সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছে। তারা বলছে, ভারতের ’প্রতিবেশী প্রথম’ নীতির কেন্দ্রে আছে বাংলাদেশ। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ভারতের বঙ্গোপসাগর ও ইন্দো–প্যাসিফিক কৌশলের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দিল্লির চোখে তাই বাংলাদেশ কেবল শুধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র নয় বরং আঞ্চলিক স্বার্থের অংশ হিসেবেই বিবেচনা করছে।

এই রিপোর্টে কমিটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছে।

অগাস্ট ২০২৪

রিপোর্টে ২০২৪ সালের পাঁচ অগাস্টের পট পরিবর্তনকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালের পর ভারত সবচেয়ে বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে আছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছে।

তবে এই পরিবর্তনকে শুধু রাজনৈতিক নয় বরং প্রজন্ম, আদর্শিক ও কৌশলগত মাত্রা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ঐকমত্য দুর্বল হওয়া, নতুন রাজনৈতিক শক্তি, উগ্রপন্থিদের উত্থান এবং চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে এসব পুনঃসমন্বয় না করতে পারলে ঢাকায় দিল্লি তার কৌশলগত অবস্থান হারাতে পারে।

তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ অস্থিতিশীল হবে না বলেও মনে করছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটি। কারণ হিসাবে তাদের মূল্যায়ন বলছে, বাংলাদেশের পরিচয় শুধু ধর্মীয় নয় ভাষা ও সংস্কৃতিও বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার ভিত্তি।

একই সাথে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের সেনাবাহিনী অত্যন্ত পেশাদার এবং তারা নিজেদের নাগরিকদের মনোভাবনার বিরুদ্ধে যায় না।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সংসদীয় কমিটির কাছে বলেছেন, “ভারত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কাজ করে যাচ্ছে”।

তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে দ্বিপাক্ষিক আলাদা করে দেখতে চায় ভারত। গঠনমূলক, বাস্তববাদী, পারস্পরিত স্বার্থ ও ভবিষ্যতমুখী সম্পর্কই চান তারা।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছে ভারতের লোকসভার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক কমিটি।

শেখ হাসিনাকে যে কারণে আশ্রয় দিয়েছে ভারত

গণঅভ্যুত্থানের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে ভারত। এ নিয়ে সংসদীয় কমিটির একাধিক সদস্যের প্রশ্ন ছিল ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের কাছে।

উত্তরে তিনি বলেছেন, “অস্তিত্বের সংকটে যে কেউ আমাদের সহায়তা চেয়েছে, আমরা তার জন্য আমাদের দরজা খুলে দিয়েছি। এই পরিস্থিতিও তার ব্যতিক্রম নয়।”

তবে ভারতে শেখ হাসিনার থাকা দুই দেশের সম্পর্কে কোনও প্রভাব ফেলছে না বলেও মনে করেন তিনি।

ভারতে বসে শেখ হাসিনা যে বক্তব্য দিচ্ছেন সেই বিষয়ে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, “তিনি তার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বক্তব্য দিচ্ছেন। ভারত সরকার তাকে এক্ষেত্রে কোনও সহযোগিতা করছে না।”

তিনি উল্লেখ করেছেন যে ভারত কখনই তার ভূখণ্ডে বসে অন্য কোনও দেশের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সমর্থন করে না।

নির্বাচন ও গণতন্ত্র

ভারতের সংসদীয় কমিটির প্রতিবেদনে আসন্ন নির্বাচন নিয়েও মূল্যায়ন করেছে। এক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ আছে ভারতের।

বড় রাজনৈতিক অংশীজন নির্বাচনের বাইরে থাকলে এর গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।

সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ

ভারতের সংসদীয় কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে আছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গ। এ নিয়ে গভীর উদ্বেগ রিপোর্টে স্পষ্ট।

বিশেষ করে অগাস্টের পর এ ধরনের ঘটনা বাড়ছে বলে জোর দেয়া হয়েছে। এমন দুই হাজার চারশ ঘটনা ঘটেছে উল্লেখ করে কমিটির মূল্যায়ন, এর অধিকাংশেরই এখনও তদন্ত বা বিচার হয়নি।

এ বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থানও তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। সেখানে লেখা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক সহিংসতা হিসাবে দেখাতে চায়।

চীন-পাকিস্তান নিয়ে সতর্কতা

বাংলাদেশে চীন ও পাকিস্তানের প্রভাব নিয়ে সতর্ক মূল্যায়ন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে বাংলাদেশে এই দুই দেশের প্রভাব নতুন মাত্রা পেয়েছে।

তবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব কমিটিকে বলেছেন, বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক স্বতন্ত্র। এটি অন্য কোনও দেশের সাথে সম্পর্কের ওপর নির্ভরশীল নয়।

রিপোর্টে বাংলাদেশে চীনের অর্থায়নে বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। বিশেষ করে মোংলা বন্দর নিয়ে। তবে লালমনিরহাট এয়ারবেইজের কথা উল্লেখ করে রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী স্পষ্ট করেছে যে এটি আপাতত সামরিক কাজে ব্যবহার করার কোনও পরিকল্পনা নেই বাংলাদেশের।

চীনের সহযোগিতায় বাংলাদেশে অনেক প্রকল্প চলমান তা তুলে ধরা হয়েছে রিপোর্টে। তবে দেশটির পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, এগুলো পাঁচই অগাস্টের পট পরিবর্তনের পর হয়নি। বাংলাদেশে বেশ আগে থেকেই চীনের উপস্থিতি আছে।

তবে চীনের প্রভাবের উপর ভারত যে নজর রাখবে তাও স্পষ্ট বলা হয়েছে রিপোর্টে।

সীমান্ত ও বাণিজ্য

বাংলাদেশ-ভারতের স্থল সীমান্তের দৈর্ঘ্য চার হাজার কিলোমিটারের বেশি। যা পৃথিবীর পঞ্চম দীর্ঘতম যৌথ সীমানা।

সীমান্তের পশু ও মাদক চোরাচালান, আন্তসীমান্ত অপরাধসহ অন্যান্য চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরা হয়েছে রিপোর্টে। তবে এ নিয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী একযোগে কাজ করছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। এখানে বিদ্যুৎ, যোগাযোগ ও আঞ্চলিক সংযোগের বিষয়গুলো সম্পর্কের ইতিবাচক দিক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে।

ভারতের সংসদীয় কমিটির এই রিপোর্টে স্পষ্ট যে বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের আঞ্চলিক কৌশল অসম্পূর্ণ। তবে গণতন্ত্র, সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ইস্যুতে যে উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে তাও আছে এখানে।

২০২৫ সালের ৪ঠা এপ্রিল থাইল্যান্ডে বিমসটেক সম্মেলনের সাইডলাইনে বৈঠক করেন প্রফেসর ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদি।

রাজনৈতিক সরকারেই সমাধান?

বাংলাদেশ ভারতের চলমান সম্পর্কের টানাপোড়েন বাস্তবতার নিরিখেই কমবে বলে মনে করেন দুই দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন এর ভবিষ্যত নির্ভর করছে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর।

দিল্লির ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন, বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক নিয়ে দুই দেশেইর নতুন করে ভাবা দরকার। কূটনৈতিক গবেষণা হওয়া উচিত।

তিনি বলছিলেন, “দুই দেশেই মিডিয়াতে যে ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে তাতে আসলে সিংহভাগ মানুষের ভাবনা প্রতিফলিত হয় না। দুই দেশেই কিছু ‘এলিমেন্ট’ থাকে যারা সম্পর্ক শীতল করতে চায়”।

প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত বলছেন, “ভারতে যে ন্যারেটিভ তৈরি হয়েছে যে বাংলাদেশ পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে, এখান থেকে যেমন বের হতে হবে, একইভাবে বাংলাদেশকেও ওই বার্তা কার্যকরভাবে প্রকাশ করতে হবে।”

আওয়ামী লীগের লেন্স থেকে বেরিয়ে বাস্তবতার নিরিখে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক নিয়ে ভাবার সময় এসেছে বলে মনে করেন প্রফেসর দত্ত।

তবে নির্বাচন হওয়ার আগে যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের টানাপোড়েন কমার সম্ভাবনা নেই তা স্পষ্ট বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাহাব এনাম খান।

তিনি বলছেন, “৫ই অগাস্ট পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রাজনৈতিক যোগাযোগের যে বিশাল ঘাটতি আছে সেটা বারবার কূটনৈতিকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে।”

“এটা স্পষ্ট যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকার না আসা পর্যন্ত ভারতের দিক থেকে সম্পর্ককে ‘নরমালাইজ’ করার বড় উদ্যোগ দেখা যাবে না,” বলেন অধ্যাপক সাহাব এনাম খান।

রাজনীতির মঞ্চের অনেক মন্তব্য দুই দেশের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করে বলে মনে করেন সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। তিনি বলছিলেন, “কিছু বিষয় আছে যে বিষয়গুলো দুই পক্ষে কাছেই স্পর্শকাতর। সেই ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে, যাদের বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ আছে তাদের সেই বিষয়গুলোর সম্পর্কে একটু বেশি সংবেদনশীল হওয়া প্রয়োজন।”

প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত মনে করেন এই বাস্তবতা দুই দেশের ‘সিনিয়র লিডারশিপ’ খুব ভালো করেই জানেন এবং বোঝেন। বাংলাদেশে যে-ই ভোটে জিতুক না কেন, একটা রাজনৈতিক সরকার এলে সমস্যা সমাধানের পথ বের হবে বলে তিনি আশাবাদী।

তিনি বলছিলেন, “বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক ভালো না থাকলে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় প্রভাব ফেলবে। তা কারো জন্যই ভালো হবে না।”

বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার দেব মুখার্জি বলছেন, “একটা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াশীল সম্পর্ক চলছে। পরিস্থিতিগত অস্থিরতার কারণে হচ্ছে এটা। তবে আমি এতে স্থায়ী ক্ষতি হওয়ার শঙ্কা দেখি না।” 

“দুই দেশ নয় শুধু, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার স্বার্থেই সম্পর্ক ঠিক হবে,” বলেন দেব মুখার্জি।

তিনি বলছিলেন, “কূটনৈতিক সম্পর্কে স্থায়ী বন্ধু স্থায়ী শত্রু বলে কিছু নেই। কিন্তু প্রতিবেশী স্থায়ী।”