মন্তব্য প্রতিবেদন

তারা প্রফেসর ইউনূসের কথা শুনলেন না, তারা শুনলেন কার কথা?

বাংলাদেশের মানুষ প্রথম আলোকে, ডেইলি স্টারকে গালিগালাজ করেছে, কিন্তু পরদিন সকালে আবার এই পত্রিকা দুটির জন্যই অপেক্ষা করেছে। নির্ভরযোগ্য খবরের আশায় প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ঢুকেছে।

আপডেট : ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৩:৪২ পিএম

বাংলাদেশের সবচাইতে বড় এবং বহুল প্রচারিত বাংলা পত্রিকাটি শুক্রবার ছাপা হয়নি। এই পত্রিকাটির ডিজিটাল বিভাগ সম্ভবত বাংলাদেশের সবচাইতে বড় ডিজিটাল অপারেশন চালায়। সেই অপারেশনও শুক্রবার এই লেখা যখন লিখছি তখন পর্যন্ত কার্যত বন্ধ রয়েছে।  

প্রথম আলো তাদের অনলাইনে একটি নোটিশ দিয়েছে, যেখানে লেখা, “বিগত রাতে প্রথম আলোর কার্যালয় ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হওয়ায় এর স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অনলাইন পোর্টালও সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। পাঠকদের কাছে এ জন্য আমরা আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি”।

বাংলাদেশের এক নম্বর ইংরেজি সংবাদপত্রটিও শুক্রবার ছাপা হয়নি। দ্য ডেইলি স্টারের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ঢুকলে একটি পপআপ আসছে শুক্রবার সকাল থেকে। সেখানে লেখা - “আমাদের অফিসে গত রাতের ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর ডেইলি স্টারের প্রকাশনা সাময়িক বিঘ্নিত হয়েছে। আমাদের অনলাইন সেবা ও প্রকাশনা পুনরুদ্ধার করার জন্য কাজ করছি। আমরা পাঠকদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাচ্ছি এবং তাদের ধৈর্য্যর প্রশংসা করছি”।

বাংলাদেশের এক নম্বর ইংরেজি সংবাদপত্রটিও শুক্রবার ছাপা হয়নি।

এই দুটি পত্রিকা ভ্রাতৃপ্রতিম। একই শিল্পগোষ্ঠী পত্রিকাদুটির উদ্যোক্তা। প্রথম আলো গত আটাশ বছর ধরে এবং দ্য ডেইলি স্টার গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বাংলাদেশের সাংবাদিকতাকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। ক্রমাগত এস্টাব্লিশমেন্টের ভুলভ্রান্তি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে। ফলে পত্রিকা দুটি সবসময় পরিচিত থেকেছে ক্ষমতাসীনদের শত্রু হিসেবে। 

শেখ হাসিনার শাসনামলে ঘোষণা দিয়ে এই দুটি পত্রিকার সাংবাদিকদের প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের সংবাদ গ্রহণ করতে দেওয়া হয়নি। সরকারি বিজ্ঞাপনতো বন্ধ করা হয়েছেই, এমনকি বেসরকারি বিজ্ঞাপনদাতাদেরও ভয়ভীতি দেখিয়ে এই পত্রিকা দুটিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছে। 

কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই কখনোই বাংলাদেশের মানুষ এসব গণমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলা করার কথা মাথায় আনেনি।

বাংলাদেশের মানুষ প্রথম আলোকে, ডেইলি স্টারকে গালিগালাজ করেছে, কিন্তু পরদিন সকালে আবার এই পত্রিকা দুটির জন্যই অপেক্ষা করেছে। নির্ভরযোগ্য খবরের আশায় প্রথম আলোর ওয়েবসাইটে ঢুকেছে।

বিদেশি গণমাধ্যমে কাজ করার সুবাদে আমি বেশ কজন আন্তর্জাতিক সাংবাদিকের সাথে পরিচিত। তারা বাংলাদেশের খবর জানার জন্য একমাত্র ডেইলি স্টারকেই চেনেন। শুধু ডেইলি স্টারকেই বিশ্বাস করেন। 

গত বছর শীতকালে জিআইজেএন নামে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার সাথে একটি দীর্ঘ অনলাইন মিটিং হয়েছিল আমার। ঘণ্টা দুয়েকের সেই আলোচনায় এই বিদেশি খ্যাতনামা অনুসন্ধানী সাংবাদিকেরা বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি নিয়ে আমার সাথে আলাপ করেছিলেন। 

আমাদের আলাপে বারবার ঘুরেফিরে আসছিল প্রথম আলো এবং ডেইলি স্টারের কথাই। তারা আফসোস করে আমাকে বলেছিলেন, ”তোমাদের দেশে এত এত গণমাধ্যম কিন্তু প্রথম আলো ডেইলি স্টার আর তোমরা বানাতে পারছো না কেন?”

আমার বন্ধু বিবিসির অ্যানবারাসন এথিরাজেন, লন্ডনে বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তার সাথে আমার মাঝে মাঝে কথা হয়। তিনি বাংলাদেশকে মূলত দেখেন ডেইলি স্টারের লেন্সে।  

এই দুটি পত্রিকার কার্যালয়ে বৃহস্পতিবার রাতে কী ঘটেছে তা এরই মধ্যে হয়তো আপনারা কমবেশি জানেন।

নজিরবিহীন হামলা

বাংলাদেশে গত রাতে নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে গেছে। মব হামলা চালিয়ে এই দুটি পত্রিকার কার্যালয় ভাঙচুর করে, অগ্নিসংযোগ করে তুলকালাম কাণ্ড ঘটানো হয়েছে। 

প্রথম আলোর যে ভবনটিতে হামলা হয়েছে, সেটিতে একসময় ডেইলি স্টারের কার্যালয় ছিল। ডেইলি স্টার ফার্মগেইটে নতুন বহুতল ভবনে স্থানান্তর হওয়ার পর কারওয়ান বাজারের পুরোনো ভবনটি প্রথম আলোকে দিয়ে দেয়।

প্রথম আলোর কার্যালয় একসময় ছিল কারওয়ান বাজারের সিএ ভবনে। সেখানে নিউজরুম রেখে তারা পাশের এই ভবনটিতে ডিজিটাল অপারেশন এবং আরো কিছু সিস্টার কনসার্নের কার্যালয় বানায়।

পরবর্তীতে পাশের প্রগতি ইনস্যুরেন্স ভবনে প্রথম আলোর নিউজরুম ও ডিজিটাল অপারেশন সরিয়ে নেয়া হয়। আর আলোচিত ভবনটিতে রয়ে যায় প্রথম আলোর আরো কিছু উদ্যোগ, যেমন প্রথমা প্রকাশনী, চরকি এবং বন্ধুসভার অফিস। সেখানে আরো ছিল প্রথম আলোর অ্যাকাউন্টস, মার্কেটিং এবং সিকিউরিটি টিমের অফিস। 

 

আগুনে দৈনিক প্রথম আলোর অ্যাকাউন্টস ও মার্কেটিংয়ের যাবতীয় নথি পুড়ে গেছে।

এগুলো সব তছনছ করা হয়েছে। প্রথম আলোর অ্যাকাউন্টস ও মার্কেটিংয়ের যাবতীয় নথি পুড়ে গেছে। এই ক্ষতি সহজে পুষিয়ে উঠতে পারবে না তারা। 

ডেইলি স্টারের হামলার ঘটনা আরো ভয়াবহ। ফার্মগেইটের এই বহুতল ভবনটিতে যখন বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয় তখন ভবনটির ভেতরে আটকে পড়েছিলেন ডেইলি স্টারের অন্তত ২৫ জন সংবাদকর্মী।

এদের একজন জাইমা ইসলাম। তিনি বাংলাদেশের একজন সুপরিচিত অনুসন্ধানী সাংবাদিক। তার কিছু অনুসন্ধানী কাজ খুবই প্রশংসিত।

জাইমার করা রিপোর্টের মধ্যে একটির কথা মনে আছে আমার যেখানে তিনি অনুসন্ধান করে দেখিয়েছেন কীভাবে পালিয়ে যাওয়ার সময় শেখ হাসিনার বিমানটিকে রেডারের আওতামুক্ত রাখা হয়েছিল। বিমানবন্দর সংক্রান্ত জাইমার আরো কিছু অনুসন্ধানী রিপোর্ট বাংলাদেশে বেশ সাড়া ফেলেছিল। জাইমার যেসব রিপোর্ট আমি মনে করতে পারি তার বেশিরভাগই বাংলাদেশের জুলাই স্পিরিটের পক্ষে যায় এবং কোন না কোনভাবে  শেখ হাসিনা সরকারের বিপক্ষে যায়। 

সেই জাইমা ইসলামও আক্রান্ত ভবনটির ভেতরে আটকে পড়াদের মধ্যে। সেখানে যারা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করেছেন তারা আপাতদৃষ্টিতে ওসমান হাদির মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ এবং জুলাই স্পিরিটের পক্ষের মানুষ। 

আটকে পড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে জাইমা ফেসবুকে লিখেছিলেন, “আমি আর নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। এত ধোঁয়া! তোমরা আমাকে মেরে ফেলছো!” 

এই স্ট্যাটাসটি ভাইরাল হয়েছে। প্রায় চার হাজার বার শেয়ার হয়েছে ফেসবুকে। স্ট্যাটাসটি লেখার পর জাইমা হয়তো ভাবছিলেন এটিই ফেসবুকে লেখা তার শেষ স্ট্যাটাস। তার সৌভাগ্য তিনি বেঁচে গেছেন। 

গভীর রাতে স্টারের আটকে পড়া সাংবাদিকদের বের করে আনেন উদ্ধারকারীরা।

এবার একজন সাংবাদিকের কথা বলি। নুরুল কবির। তিনি নিজেই একজন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেেশের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাংবাদিকদের তালিকায় তাকে এক নম্বরে রাখতে হবে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার নানা ভুলভ্রান্তি ক্রমাগত সামনে এনেছেন নুরুল কবির ও তার পত্রিকা নিউ এইজ। দিনের পর দিন গুম নিয়ে রিপোর্ট করে গেছেন। কোন হুমকি, ভয়ভীতি, রাষ্ট্রের চাপ তাকে এই সাংবাদিকতা করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। 

জামায়াত ইসলামী শেখ হাসিনার আমলে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে যে ‘ক্যাঙ্গারু কোর্ট’ বলে ডাকতে পেরেছিল বা আজও পারে তার মূলভিত্তিই তৈরি হয়েছে নুরুল কবিরের সাংবাদিকতার প্রেক্ষাপটে। এই কারণে হাসিনার আমলে আওয়ামী লীগ নুরুল কবিরকে ‘রাজাকার’ বলেও ডেকেছে।

বাংলাদেশে গণমাধ্যমের সম্পাদকদের সংগঠন সম্পাদক পরিষদের এখনকার সভাপতি তিনি। সেই দায়িত্ববোধ থেকেই ডেইলি স্টার আক্রান্ত হবার খবর শুনে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন নুরুল কবির। সেখানে বিক্ষোভকারীরা এই নুরুল কবিরের গায়ে হাত তুলেছে। তার চুল ধরে টানাটানি করেছে। তাকে হেনস্তা করেছে। এসময় তাকে ‘ফ্যাসিবাদের দালাল', ‘আওয়ামী লীগ’ ইত্যাদি বলে ডাকছিল বিক্ষোভকারীরা। 

ডেইলি স্টার ভবনে বিক্ষোভকারীদের হেনস্তার পর ভেতরে আটকে পড়া অবস্থায় চ্যানেল ওয়ানকে টেলিফোনে দেয়া এক সাক্ষাতকারে নুরুল কবির বলেছেন, “আমাকে তারা সুশীল বলে গালি দিয়েছে। অথচ এই সুশীলতার বিরুদ্ধে আমি গত তিরিশ বছর সংগ্রাম করেছি। এটা কৌতুক নয়, আমি তাদের দেশপ্রেমকে প্রশ্ন করি না। কিন্তু তারা যে আমার দেশপ্রেমকে প্রশ্ন করেছে, এইটা স্রেফ আমি তাদের ব্যাপারে করুণা বোধ করি।” 

 

সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিক কেন টার্গেট?

২০২৪ সালের জুলাই মাসে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে চারিদিকে যখন নিউজ ব্ল্যাকআউট চলছিল তখন একমাত্র প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে পাওয়া গিয়েছিল কিছু সংবাদ। সরকারের পক্ষ থেকে যখন লাশের হিসেব দেয়া বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, কোন গণমাধ্যম যেখানে লাশের সংখ্যা ছাপতো না, সেখানে প্রথম আলো প্রতিদিন লাশের সংখ্যার আপডেট দিত, যেটা তারা সংগ্রহ করতো নিজস্ব অনুসন্ধানের মাধ্যমে। 

বাংলাদেশে যে এত বড় হত্যাযজ্ঞ চলছিল তখন সেই খবর পাওয়ার তখনকার একমাত্র উৎস ছিল প্রথম আলো। আর যতদূর মনে পড়ে ডেইলি স্টারই প্রথম আবু সাইদ হত্যাকাণ্ডের খবরটি সাহসিকতার সাথে তুলে ধরেছিল, যেটা অন্য কোন গণমাধ্যমে চোখে পড়েনি। 

এখন তাদের উপর হামলা চালানোর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে তারা নাকি ফ্যাসিবাদী! 

প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ সুনির্দিষ্ট, ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর পত্রিকাটি তার একটি প্রোফাইল ছেপেছিল যেখানে তার শিক্ষাজীবনের মাদ্রাসায় পড়া এবং ধর্মীয় পোশাকের বিবরণ ছিল। এটা নিয়ে ওসমান হাদির সমর্থকেরা বিক্ষুব্ধ হন। ক্ষোভ ও বিতর্কের প্রেক্ষাপটে প্রথম আলো অনলাইন থেকে প্রতিবেদনটি সরিয়েও নেয়। কিন্তু সেই ক্ষোভ কি এতটা মারাত্মক ক্ষোভ ছিল যে পত্রিকাটির অফিস ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দিতে হবে?

ডেইলি স্টারের ওপর হামলার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কী অভিযোগ ছিল সেটা স্পষ্ট না। ভাঙচুর চালানোর সময় তাদেরকে ফ্যাসিবাদের ও ভারতের দালাল বলে অভিহিত করছিল বিক্ষোভকারীরা।

 

বিচ্ছিন্ন হামলা নাকি সুপরিকল্পিত

রাত বারোটার দিকে যখন প্রথম আলোতে ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ চলছে তখন ‘ইলিয়াস হোসেন’ নামে একজন আমেরিকা প্রবাসী ভ্লগারের ভেরিফায়েড ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে স্ট্যাটাস দেয়া হয়, “সবাই প্রথম আলোয় আসেন। অর্ধেক কাজ শেষ বাকিটা আপনারা করেন”।

তিনি আরো লেখেন “প্রথম আলোর একটা ইটও যেন না থাকে”। তার কিছুক্ষণ পর লেখেন, “প্রথম আলো ডান, ডেইলি স্টারে চলে আসেন। ভারতের আস্তানা এদেশে থাকতে দেয়া হবে না”। 

ভবনটির ভেতরে আটকে পড়েছিলেন ডেইলি স্টারের অন্তত ২৫ জন সংবাদকর্মী।

গত রাতে যখন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটিতে ১৬ মাসের মধ্যে চতুর্থবারের মত ভাংচুর চালানো হচ্ছিল, তখন প্যারিস থেকে আরেকটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন আরেকজন প্রবাসী বাংলাদেশি। তার নাম পিনাকী ভট্টাচার্য। তিনি লিখেছেন, “ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের সিঁড়িটা খেয়াল রাখবেন। ওইটা থেকে গেলে মন্দির বানাবে। খেয়াল রাইখেন”। 

এই দুইজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে গত জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অনেক মব আক্রমণ উসকে দেয়ার অভিযোগ আছে।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর এই হামলার পেছনে কি তারা দায়ী? বিষয়টি হয়তো এত সরল নয়।

গত রাতে হামলা ভাঙচুরের পর থেকেই প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত একে-ওকে টানা ফোন দিয়ে গেছি। তাদের খোঁজখবর নিয়েছি। যে কজনের সাথে কথা বলেছি, তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, এই হামলা কোন হঠাৎ হামলা নয়। একেবারেই পূর্বপরিকল্পিত। যেন হাদির মৃত্যুর খবরের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন তারা, বলছিলেন একজন।

একজনের সঙ্গে আলাপ করার সময়, আমি তাকে ইলিয়াস ও পিনাকীর স্ট্যাটাসগুলো মনে করিয়ে দিচ্ছিলাম। 

জবাবে তিনি বলেন, তাদের চেয়েও অনেক বড় শক্তি হয়তো এখানে যুক্ত আছে। তাদের ফেইসবুকে দেওয়া ডাকে হয়তো একজন দুজন মানুষ এগিয়ে আসতে পারে। কিন্তু এমন সংঘবদ্ধ হামলার নেতৃত্ব স্রেফ ফেইসবুক-টেলিগ্রাম দিয়ে সম্ভব না।

 

সহিংসতার আশঙ্কা কি সরকার আগেই করেছিল?

ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর বের হওয়ার আধা ঘণ্টার মধ্যেই প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস জানান তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবেন। তার কিছু পরে দেয়া সেই সংক্ষিপ্ত ভাষণে প্রফেসর ইউনূস, হাদির মৃত্যুতে শোক জানান, কিছু উদ্যোগের কথা জানান, কিন্তু তার বক্তব্যের মূল অংশ বলে যেটা মনে হয়েছে আমার কাছে সেটা ছিল একটি আহ্বান - আপনারা ধৈর্য্য ধারণ করুন, হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবেন না। 

হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে এমন একটা বক্তব্য দেওয়ার একটা উদ্দেশ্যই থাকতে পারে, প্রধান উপদেষ্টা হয়তো আশঙ্কা করছিলেন কোন অনাকাঙ্খিত ঘটনার। হয়তো গোয়েন্দা তথ্য ছিল তার কাছে। 

আরও পড়ুন: প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয়ে হামলা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ 

বিষয়টি আরো স্পষ্ট হয় যখন প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ দেয়ার কিছু পর তিন সাবেক ছাত্র উপদেষ্টা, যাদেরকে এককালে নিয়োগকর্তা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন প্রফেসর ইউনূস সেই নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং মাহফুজ আলম শাহবাগে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের ‘শান্তিপূর্ণভাবে’ আন্দোলন করার আহবান জানান। 

তারা জনগণের এই ক্ষোভকে ব্যবহার করে স্যাবোটাজের আশঙ্কা করছিলেন। তারা বলছিলেন, এই ক্ষোভের সুযোগে একদল ষড়যন্ত্রকারী নির্বাচন বানচালের চেষ্টা চালাতে পারে। 

তাদের এই আহ্বানে যে কাজ হয়নি, সেটা স্পষ্ট হয় রাতভর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ভাংচুর অগ্নিসংযোগের মধ্যে দিয়ে, বিশেষ করে গণমাধ্যমের কার্যালয়ে ন্যাক্কারজনকভাবে নজিরবিহীন হামলার মধ্যে দিয়ে।

 

সরকারে অস্বস্তি

বাংলাদেশে গত ষোলো মাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে গঠিত এই সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির যেকোনও কর্মকাণ্ডে তেমন কোন আপত্তি জানায় না, বরং অনেক ক্ষেত্রেই পরবর্তীতে তাদের সমর্থন দেয়।

কিন্তু বৃহস্পতিবারের ঘটনাপ্রবাহের পর স্পষ্টতই সরকারে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। 

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস টেলিফোনে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের সাথে কথা বলেছেন। 

প্রধান উপদেষ্টা তাদের বলেছেন, “দেশের শীর্ষস্থানীয় দুটি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ওপর এই হামলা স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর হামলার শামিল। এই ঘটনা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার পথে এক বিরাট বাধা সৃষ্টি করেছে”।

সংস্কৃতি উপদেষ্টা বৃহস্পতিবার রাতের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে একাধিক স্ট্যাটাস দিয়েছেন ফেইসবুকে। রাতে যখন ঢাকায় সহিংসতা চলছিল তখন তিনি লিখেছেন, “আপনারা হাদির স্পিরিটকে অপমান করছেন”।

আরেকটি স্ট্যাটাসে তিনি লিখেছেন, “দয়া করে সংযত হন। কারো উস্কানিতে পা দিয়েন না। আলোচনাটা আমাদের সময়ের বীর হাদী থেকে অন‍্য দিকে কারা ঘুরিয়ে দিতে চায় সেটা মাথায় রাখেন”।

সদ্যবিদায়ী তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম লিখেছেন, “বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে, চরম ডানপন্থি রাজনীতির উত্থান রোধ করতে হবে। এটি একটি জরুরি জাতীয় দায়িত্ব”। 

আর প্রধান উপদেষ্টা প্রেস উইংয়ের একজন সদস্য এবং উপ প্রেস সচিব আজাদ মজুমদার লিখেছেন, “আমি শোকাহত, দুঃখিত এবং লজ্জিত”।

আসলেই, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের উপর বৃহস্পতিবার রাতে যে আঘাতটা এলো সেটি লজ্জিত হওয়ার মত একটি ব্যাপারই বটে।