হামজার হাত ধরেই ফুটবলের গৌরব ফেরার ইঙ্গিত

উনিশশো আশির দশকের বাংলাদেশে ফুটবল ছিল শুধু একটা খেলা নয় - ছিল শহরের ছন্দ, মহল্লার শব্দ, আর মানুষের আবেগের জায়গা। দীর্ঘ বিরতির পর সেই হারানো গৌরব ফেরার হাতছানি মিলছে হামজা চৌধুরীর আগমনে। মোমেন্টাম ধরে রাখতে এখন কী করতে হবে?

আপডেট : ০১ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১৩ পিএম

বাংলাদেশে ফুটবল যে আবার আলোচনার কেন্দ্রে ফিরেছে, সেই যাত্রার সামনের সারিতে হামজা চৌধুরীই আছেন।

তবে শুধু একজন তারকার ওপর ভর করে দেশের ফুটবলের ভবিষ্যত বদলে ফেলা সম্ভব নয়। সামগ্রিক উন্নতির জন্য ক্লাব ফুটবলে উন্নয়ন জরুরি।

বাংলাদেশের লিগ কাঠামো দীর্ঘদিন ধরেই নানা সমস্যায় জর্জরিত- দলসংখ্যা কম, মৌসুম ছোট, বয়সভিত্তিক লিগ অনিয়মিত, অবকাঠামো দুর্বল, আর বেশির ভাগ ক্লাবেরই খেলোয়াড় তৈরির কোনো স্থায়ী পরিকল্পনা নেই।

জাতীয় দলের শক্তি মূলত ক্লাব ফুটবল থেকেই তৈরি হয়। ক্লাবগুলো মানসম্পন্ন প্রতিযোগিতা, দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন ও স্থির পরিবেশ না দিলে জাতীয় দলে ধারাবাহিক পারফরম্যান্স আসবেই না।

হামজা চৌধুরীর প্রভাব তাই এক ধরনের ‘উদ্বোধনী স্ফুলিঙ্গ’র মতো। কিন্তু আলোটা ধরে রাখতে হলে ক্লাব ফুটবলের কাঠামো বদলাতে হবে।

দীর্ঘ লিগ মৌসুম, বয়সভিত্তিক লিগ নিয়মিত করা, ক্লাবগুলোর একাডেমি গড়ে তোলা, কোচিং মানোন্নয়ন, প্রফেশনাল ম্যানেজমেন্ট- এসব ছাড়া জাতীয় দলের সাফল্য কেবল বিচ্ছিন্ন ঘটনাই থেকে যাবে।

অর্থাৎ, হামজা জনপ্রিয়তা ফিরিয়ে এনেছেন - এখন সেই জনপ্রিয়তাকে স্থায়ী শক্তিতে রূপ দিতে হলে দেশের ক্লাব ফুটবলের ভিত্তিটাকেই শক্ত করতে হবে।

আর সেই জনপ্রিয়তার তুলনা হতে পারে কেবল আশির দশকে বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবল নিয়ে উন্মাদনার সাথেই।

ফুটবলের হারানো দিন

আশির দশকের বাংলাদেশে ফুটবল ছিল শুধু একটা খেলা নয়- এটা ছিল শহরের ছন্দ, মহল্লার শব্দ, আর মানুষের আবেগের জায়গা।

বিকেল হলে ঢাকার রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত, দোকানে টিভির সামনে ভিড় জমত, আর রেডিওর শব্দ উঠোন পেরিয়ে পাশের বাড়িতেও পৌঁছে যেত।

কারণ সেদিন মোহামেডান খেলছে, আবাহনী খেলছে, দেশ তখন এমনভাবেই ফুটবলে বাঁচত। সেদিনের ক্লাব ফুটবল ছিল যেন এক অপার্থিব নাট্যমঞ্চ।

ঢাকার স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে জায়গা পাওয়া ছিল সৌভাগ্যের ব্যাপার। একপাশে সাদা-কালো পতাকার ঢেউ, অন্যপাশে নীল-হলুদের গর্জন। মানুষের মধ্যে বিভাজন ছিল, কিন্তু সেটা ছিল আনন্দের। শৈশবটা কারো আবাহনী, কারো মোহামেডান। অফিসে সহকর্মী ঝগড়া করেছে, আবার সন্ধ্যায় একসঙ্গে চা খেয়েছে।

খেলোয়াড়দের নাম ছিল কিংবদন্তির মতো উচ্চারিত - কায়সার হামিদ, গোলাম রব্বানী ছোটন, আতিকুল ইসলাম আতিক, রুমী, বাদল রায় - যাদের খেলা দেখতে মানুষ দূরদূরান্ত থেকে আসত।

মাঠ তখন ছিল তারকাদের আলোয় চমকানো একটা মঞ্চ। তারা বল পায়ে ছন্দ তুললে গ্যালারি যেন একসঙ্গে শ্বাস নিতে ভুলে যেত।

আশির দশকের ক্লাব ফুটবল ছিল মানে উন্মাদনা, প্রতিভা, আর অসীম আবেগের সমাহার। ডার্বি মানে ছিল উৎসব। রিকশায় পতাকা, মাথায় ব্যান্ড, পাড়ায় পাড়ায় পোস্টার- ঢাকা শহরের হাওয়ায়ও যেন ফুটবল ভাসত।

সেই সময় ফুটবল ছিল বিনোদনের প্রধান মাধ্যম, আর ক্লাবগুলো ছিল পরিবারের মতো, যেখানে সমর্থকের ভালোবাসা বিনিময়ে ফুটবলারদের কাছ থেকে পাওয়া যেত হৃদয়ের খেলা। টাকা–পয়সা কম ছিল, পেশাদারিত্ব সীমিত ছিল, কিন্তু আবেগ ছিল অফুরন্ত।

সেদিনের ক্লাব ফুটবল তাই আজও মনে পড়ে এক বিশেষ উষ্ণতার সঙ্গে, যেন একটা সরল সময়, যখন গ্যালারির চিৎকারে শহরের হৃৎস্পন্দন বাড়ত।

একটি দীর্ঘ প্রতিক্ষীত জয়

বাইশ বছর। ফুটবলের দিক থেকে হিসেব করলে পাঁচটা বিশ্বকাপ। এটা শুধু একটা সময় নয়। একটা অপেক্ষা। একটা হাহাকার। আর একটা স্বপ্নের হাতছানি।

ভারতের বিপক্ষে জয়ের মধ্য দিয়ে সেই দীর্ঘ অপেক্ষার অবশেষে অবসান হলো। বাংলাদেশ দলের জন্য এটা কেবল তিনটি পয়েন্ট নয়; আত্মবিশ্বাস, সামর্থ্য আর নতুন করে পথচলার ঘোষণাও।

গত দুই দশকে ভারত ফুটবলে এগিয়েছে, অবকাঠামো বেড়েছে, লিগ শক্তিশালী হয়েছে। বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে সাংগঠনিক সমস্যা, অর্থসংকট আর পরিকল্পনার অভাবে।

তাই এই জয়টা প্রতীকী। বাংলাদেশ এখনও ফুরিয়ে যায়নি, এখনও লড়তে পারে, এখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে তার প্রমাণ।

দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় দলে সাফল্যের অভাব যেভাবে দর্শকের আগ্রহ কমিয়ে দিয়েছিল, সেই জায়গায় এই এক ম্যাচই আবার আগুন জ্বালিয়ে দিল।

স্টেডিয়াম, সোশ্যাল মিডিয়া, চায়ের দোকান, সবখানে ফিরেছে ফুটবলের উত্তাপ।

দূর থেকে দাঁড়িয়ে হইহুল্লোড়ে কান পাতলে বোঝা যায়, ম্যাচ চলার সময় হয় বাংলাদেশ সহজ কোনো সুযোগ মিস করেছে অথবা প্রতিপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছে গোলবার থেকে।

সবচেয়ে বড় কথা, ভারতকে হারানো মানে দক্ষিণ এশিয়ার ফুটবল মানচিত্রে নিজেদের গুরুত্ব আবার জানিয়ে দেওয়া। 

দীর্ঘদিন ভারত ছিল অপ্রতিরোধ্য, অথচ এই জয় দেখিয়ে দিল যে ব্যবধানটা ততটা অদম্য নয়। পরিশ্রম, পরিকল্পনা আর প্রতিভা থাকলে বাংলাদেশও পারে।

এই ম্যাচ তাই কেবল একটা স্কোরলাইনের গল্প নয়। এটা আত্মবিশ্বাসে ফেরার গল্প, ফুটবল সংস্কৃতিকে নতুন করে জাগানোর গল্প, আর ভবিষ্যতের জন্য একটা বার্তা। বাংলাদেশ ফুটবল এখনও বেঁচে আছে। এবং আরও বড় স্বপ্ন দেখার সময় এসেছে।

প্রাণচাঞ্চল্য ফিরছে?

বাংলাদেশ ফুটবলে দীর্ঘদিন ধরে যে প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে গিয়েছিল, হামজা চৌধুরীর আগমন সেই হারিয়ে যাওয়া উচ্ছ্বাসকে নতুন করে ফিরিয়ে এনেছেন। তার উপস্থিতি শুধু মাঠের খেলায় নয়, পুরো ফুটবল সংস্কৃতিতেই একটা আলোড়ন তুলেছে।

হামজার গল্পটাই আলাদা - ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ থেকে উঠে আসা, লেস্টার সিটির হয়ে খেলা, বহুজাতিক শিকড় বহন করা এক তারকা।

যখন তিনি বাংলাদেশের জার্সি গায়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিলেন, তখনই ফুটবল–অনুরাগীদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়। এত বড় পরিসরের একজন খেলোয়াড় দেশের হয়ে খেলবেন, এটা ছিল বাংলাদেশের ফুটবল সমর্থকদের জন্য অবিশ্বাস্য।

তার মাঠের পারফরম্যান্সেও সেই প্রভাব স্পষ্ট। মধ্যমাঠে দারুণ নিয়ন্ত্রণ, বল দখলে শক্তি, এবং খেলার গতিপথ বদলে দেওয়ার ক্ষমতা - এসব মিলিয়ে তিনি বাংলাদেশ দলের আধুনিক ফুটবলের স্বাদ এনে দিয়েছেন।

বহুদিন পর দর্শকরা দেখেছে এমন একজন খেলোয়াড়কে, যার উপস্থিতি ম্যাচের মান একধাপ ওপরে নিয়ে যায়।

সবচেয়ে বড় ব্যাপার, হামজা শুধু বিদেশফেরত তারকা নন; তিনি নিজের পরিচয়, শেকড় আর দায়িত্ববোধকে গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশকে বেছে নিয়েছেন।

এই আন্তরিকতা সমর্থকদের মধ্যে জাতীয় দলের প্রতি নতুন করে আস্থা তৈরি করেছে। অনেক তরুণ আবার মাঠে ফুটবল খেলতে নামছে, ক্লাবগুলোতে বাড়ছে দর্শক, সোশ্যাল মিডিয়ায় ফুটবল নিয়ে আলোচনা আগের চেয়ে অনেক বেশি।

ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়ের পর হামজার প্রভাব আরও স্পষ্ট। তিনি যেন দলে আত্মবিশ্বাস ঢেলে দিয়েছেন, যে বাংলাদেশ জিততে পারে, লড়তে পারে, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।

হামজা চৌধুরীর আগমন শুধু একজন খেলোয়াড়ের গল্প নয়; এটা ফুটবলের প্রতি আগ্রহ পুনরুজ্জীবনের গল্প। তার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অনেকে আবার স্বপ্ন দেখছে, একটা শক্তিশালী, প্রতিযোগিতামূলক জাতীয় দলের।