ওয়াকম্যান ও ক্যাসেটে যে প্রজন্ম গান শুনতেন, তাদের কাছে এমপি থ্রি ও ইউটিউবে গান শোনা জেন-জিদের রুচি মনে হতো ‘যথেষ্ট অদ্ভুত ও অচেনা’। আবার এখনকার আলফাদের পছন্দের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হিমশিম খাচ্ছে জেন-জিরাই।
কে-পপ, জে-পপের বিদেশি কথা ও আধুনিক সুর, ফঙ্ক-এর উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ ও তাল, ‘লো-ফাই’ মিউজিকের ধীরগতি ও শিথিল শব্দ যেন জেন-এক্স, মিলেনিয়াল ও জেন-জিদেরও অনেকের কাছে ভিন্ন গ্রহের সংস্কৃতির মতো শোনায়।
কী শুনছে আমাদের নতুন প্রজন্ম? কোন গানগুলো তাদের মনের ভেতরের উত্তেজনা প্রশমন করতে সক্ষম হয়? জেনে আসি নতুন প্রজন্মের জনপ্রিয় কিছু গানের জনরা, শিল্পী ও ধরণ।
আমেরিকান পরামর্শক ফার্ম ম্যাকিঞ্জি অ্যান্ড কোম্পানির মতে, “এশিয়া ধীরে ধীরে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। আগে এ অঞ্চলটিতে মূলত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির বিস্তার ছিল এবং এশিয়ার মানুষজন হলিউড সিনেমা ও ব্রিটিশ পপ সংগীতের উৎসাহী ভোক্তা ছিল।”
তবে এখন সংস্কৃতির প্রবাহ দুই দিকেই চলে বলে মনে করে ম্যাকিঞ্জি।
ফঙ্ক, ইডিএম, লো-ফাই

ফঙ্কে উচ্চ ফ্রিকুইয়েন্সির কিছু বিট চলতে থাকে বারবার, ব্যাকগ্রাউন্ডে কখনো আবছাভাবে শোনা যায় বিদেশি কোনো একটা ভাষায় কণ্ঠ। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর আসে একটা ‘বিট ড্রপ’, যার পরই ভলিউম ও গতি বেড়ে যায়।
এই মিউজিক সাধারণত পাওয়া যায় রিলসে, কোনো সিনেমা বা ওয়েব সিরিজের দৃশ্যের পেছনে বসানো হয়- যেখানে মূল চরিত্র খুব অসাধারণ কিছু একটা করছে বা বলছে। তখনই বাজতে শুরু করে ফঙ্ক মিউজিক।
সাধারণত এডিট করে বানানো হয় এসব রিলস। এতে দেখা যায় হলিউড তারকা ক্রিশ্চান বেইল, কিলিয়ান মার্ফি, টম হার্ডি, হেনরি ক্যাভিল কিংবা অ্যান্থনি স্টারদের মত তারকাদের।
আবার জিম করতে গিয়েও অনেক তরুণ শোনের ফঙ্ক মিউজিক। কেন জিমে এই মিউজিক শোনা হয়, তা নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন ঢাকার এক স্কুলছাত্র রাইয়ান বিন আশরাফ।
“এই গানের চাঞ্চল্যকর তাল ও ছন্দ কোনো একটা কঠিন কাজ করার সময় এক ধরনের অ্যাড্রেনালিন বুস্টের জোগান দেয়,” বলেন ওই কিশোর।
আরেকটি হলো- ইডিএম বা ইলেকট্রনিক ড্যান্স মিউজিক। এটা ফঙ্কের মতো নতুন নয়, কয়েক দশক ধরেই হচ্ছে এই ধরনের জনরার বিকাশ।
শরীর দুলিয়ে নাচার মতো তাল সৃষ্টিকারী এই মিউজিক বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করেছে নতুন প্রজন্মের কাছে। বিভিন্ন ‘রেইভ’ পার্টিতে শুধু ইডিএম বাজিয়েই দেশ ও বিদেশের তরুণদের উল্লাস করতে দেখা যায়।
আরেকটি জনরা হলো ‘লো-ফাই’। উচ্চগতির ফঙ্ক ও ইডিএম-এর বিপরীতে ধীর গতির, শিথিল শব্দের এই মিউজিক জনরাও জনপ্রিয়তা পেয়েছে জেন-জি ও জেন আলফার কাছে।
পড়াশোনা করতে করতে শোনার জন্য বিভিন্ন ‘লো-ফাই’ রিমিক্স পাওয়া যায় ইউটিউবে, যা জনপ্রিয়তা পেয়েছিল কোভিডের লকডাউনের সময়।
আবার অন্যান্য জনরার বিভিন্ন গানের গতি ও ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে এবং সাথে একটি হালকা বিট লাগিয়ে সেগুলোর ‘লো-ফাই’ ভার্সনও নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয়।
সম্প্রতি ভারতীয় উপমহাদেশের টিকটক, ফেইসবুক ও ইন্সটাগ্রামের রিলসে ছড়াতে দেখা গেছে বিভিন্ন আধুনিক, নজরুল ও রবীন্দ্র সংগীত এবং কাওয়ালি সংগীতের লো-ফাই ভার্সন। আধুনিক বাংলা গানেরও লো-ফাই ভার্সন শুনে থাকে নতুন প্রজন্ম।
কে-পপ, জে-পপ, অ্যানিমে মিউজিক

গত এক দশক ধরে পূর্ব-এশীয় সংস্কৃতির ছড়াছড়ি দেখা গেছে ভারতীয় উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে- প্রধানত কোরিয়ান ও জাপানিজ সংস্কৃতির।
কোরিয়ান সংস্কৃতি এতদূর এসেছে মূলত কে-পপ গান ও কে-ড্রামার মাধ্যমে। এটি শুধু জেন-আলফার নয়, জেন-জিরও বিরাট অংশ কে-পপ বা কোরিয়ান পপ সংগীতের ভীষণ ভক্ত।
কে-পপ ব্যান্ড বিটিএস, ব্ল্যাকপিঙ্ক, সেভেনটিন, এক্সো, প্রমুখের আধুনিক সুর ও বিটের গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি করেছে বিশ্বব্যাপী।
কোরিয়ান শিল্পী ‘সাই’-এর ‘গ্যাংনাম স্টাইল’ গানের মিউজিক ভিডিও ইউটিউবের ‘মোস্ট-ভিউড’ ভিডিও ছিল ২০১২ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত।
জাপানিজ ভাষায় ও অনন্য জাপানিজ স্টাইলে আঁকা অ্যানিমেটেড সিরিজকে মূলত অ্যানিমে বলা হয়। জাপানিজ সংস্কৃতি মূলত ছড়িয়েছে অ্যানিমের মাধ্যমে।
পোকিমন, ড্রাগন বল-জি, নারুতো, ডেথ নোট, অ্যাটাক অন টাইটান, ডিমন স্লেয়ার, টোকিও ঘুল, জুজুৎসু কাইসেনের মতো জাপানিজ অ্যানিমে সিরিজ সারাবিশ্বের সব বয়সের মানুষ দেখে থাকে।
এই সিরিজগুলোতে ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন জনপ্রিয় জাপানিজ শিল্পী ও ব্যান্ডের গান, যা সিরিজগুলোর মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পেয়েছে বিশ্বজুড়ে।
এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানগুলো হলো- টোকিও ঘুল সিরিজে ব্যবহৃত শিল্পী ‘টিকে’-র গান ‘আনর্যাভেল’, অ্যাটাক অন টাইটান সিরিজে ব্যবহৃত ‘লিংকড হরাইজন’ ব্যান্ডের ‘গুরেন নো ইউমিয়া’, ‘শিনজো উও সাসাগেয়ো’ ও “সিম” ব্যান্ডের ‘রাম্বলিং’, ডিমন স্লেয়ার সিরিজে ব্যবহৃত শিল্পী লিসার গান ‘গুরেঙ্গে’ ইত্যাদি।
অ্যানিমের বাইরেও স্বতন্ত্রভাবেও জাপানিজ পপ গান বা জে-পপের জনপ্রিয়তা আছে নতুন প্রজন্মের কাছে। ‘কিয়ারি পামিউ পামিউ’ ও ‘ফুজি কাজে’র মতো জাপানিজ পপ শিল্পীদের এ ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা আছে।
টিকটক ও ইন্সটাগ্রাম রিলসে ট্রেন্ডিং গান

টিকটক ও ইন্সটাগ্রামের রিলসের অডিওতে বিভিন্ন গান পাওয়া যায় যা তুলনামূলক পুরোনো হলেও হঠাৎ হঠাৎ ট্রেন্ডিং হয়ে ওঠে- বিশেষ করে কেউ কেউ যখন সেটি রিলসে ব্যবহার করেন।
কখনো কখনো পুরোনো গানও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এভাবেই। বনি এমের ‘রাস্পুতিন’, ‘ওয়ান ওয়ে টিকেট’, ইতালিয়ান বিদ্রোহী গান ‘বেলা চাও’, বিলি জোয়েলের ‘পিয়ানো ম্যান’, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের জার্মান গান ‘এরিকা’ ও সোভিয়েত গান ‘ডার্ক ইজ দা নাইট’ এভাবেই জনপ্রিয়তা পায়।
উপমহাদেশেও দেখা গেছে এই চল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে, মোহাম্মদ রফি, নুসরাত ফতেহ আলি খান, লতা মঙ্গেশকরের গলা হঠাৎ শোনা যায় কোনো রিলের ব্যাকগ্রাউন্ডে- এতে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত হয় গানগুলো।
সম্প্রতি অনেক রিলের ব্যাকগ্রাউন্ডেই শোনা গেছে মহীনের ঘোড়াগুলির ‘হায় ভালোবাসি’।
পপ, হিপ হপ, ইন্ডি

নতুন নতুন জনরার জনপ্রিয়তার মধ্যে পপ, হিপ হপের প্রভাব এখনো আছে প্রজন্মের ওপর। এখন পপ শিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয়- টেইলর সুইফট, বিলি আইলিশ, লেডি গাগা, ব্রুনো মার্স, কেন্ড্রিক লামার, দা উইকেন্ড, আরিয়ানা গ্রান্ডে, সাব্রিনা কার্পেন্টার, এমিনেম কে।
র্যাপ গান সবসময়ের মতো জনপ্রিয় থাকলেও হিপ হপ বিশ্বে দেখা যাচ্ছে ‘মাম্বল র্যাপ’-এর উঠতি জনপ্রিয়তা। এখানে মূলত র্যাপারের গানের কথাগুলোর উচ্চারণ পরিষ্কার থাকে না এবং সাধারণ র্যাপের মতো গতিশীলও না।
তবে এখন অনেক বেশি জনপ্রিয় ইন্ডি গান। ইন্ডি বলতে মূলত বোঝানো হয় সেইসব শিল্পীদের- যারা বড় বড় কমার্সিয়াল রেকর্ড লেবেলের সাথে সম্পৃক্ত না হয়ে স্বাধীনভাবে সংগীত করেন।
ইন্ডি ব্যান্ড ও শিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয় - গ্লাস অ্যানিমালস, সিগারেটস আফটার সেক্স, মিটস্কি, আর্কটিক মাঙ্কিস, কোনান গ্রে, টুয়েন্টি ওয়ান পাইলটস, গার্ল ইন রেড, বিবাডুবি প্রমুখ।
উপমহাদেশে যা জনপ্রিয়

ভারতীয় উপমহাদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে উপরের জনরাগুলো ছাড়া আরও অনেক ধরনের সংগীত জনপ্রিয় হয়েছে।
রিলস ও মিমসের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে কিছু বিহারি ও ভোজপুরি গান। সম্প্রতি জনপ্রিয় হওয়া গানের দুটি উদাহরণ হলো- ‘ললিপপ লাগেলু’ ও ‘মাই কে দিয়া গালি বাত পে’।
ভারতীয় ইন্ডি শিল্পী ‘আনুভ জেইন’ ও ব্যান্ড ‘কাভিশ’ এখন অনেক জনপ্রিয়। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় কোক স্টুডিও।
কোক স্টুডিও ও কোক স্টুডিও বাংলার প্রায় প্রত্যেকটা গানই রিলিজের পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
এক প্রজন্মের সাথে আরেক প্রজন্মের রুচি কখনই মেলে না। জেন জি ও জেন অ্যালফা ইন্টারনেটের সাথে বড় হওয়া প্রজন্ম হওয়ায়, বিশ্বের নানা সংস্কৃতি ও সংগীতের সাথে তাদের মিথস্ক্রিয়া হয়েছে।
নিজেদের সময়ের গান বাদেও তারা শোনার সুযোগ পেয়েছে পুরোনো বহু গান। তাই- নতুন প্রজন্মের মধ্যে গানের রুচি ও পছন্দ নিয়ে রয়েছে নানা বৈচিত্র্য। বিদেশি পপ, ইন্ডি গান, ব্যান্ড সংগীত ও পুরোনো আমলের গান মিলিয়ে এক বৈচিত্র্যময় রুচি নিয়ে বড় হচ্ছে এই প্রজন্মের।
মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম সুইটি হাই-এর সিইও ফ্রাঙ্ক সিমোনেটিকোট ফোর্বস ম্যাগাজিনকে বলেন, “সংগীত জেন-জিদের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অজানা বা কম পরিচিত সংগীত খুঁজে পাওয়ার জন্য এখন তাদের কাছে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি অপশন রয়েছে।
জেন-জি সেই বৈচিত্র্যকে সাদরে গ্রহণ এবং বিভিন্ন সংগীত ঘরানা ও প্ল্যাটফর্মের মিশ্রণ ব্যবহার করে। যেখানে নতুন ও ঐতিহ্যবাহী উভয় মাধ্যমই সংগীতের আবিষ্কার ও উপভোগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে,” যোগ করেন তিনি।



