৫ই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ষোল মাসে ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে? লিখেছেন সাবেক বিকেএমইএ সভাপতি ও রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের ব্যবসায়ী ফজলুল হক।
ফজলুল হক
প্রকাশ : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০২:০১ পিএমআপডেট : ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:২৬ পিএম
ফজলুল হক, বিকেএমইএ এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি, প্লামি ফ্যাশনস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক
পাঁচই অগাস্টের পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি- শুধু ব্যবসায়ী না, সাধারণ মানুষও সেই প্রত্যাশায় অংশগ্রহণ করেছিল। কারণ গণঅভ্যুত্থানের পর যে সরকারই আসুক, তাদের কাছে জনগণের আশা থাকে পরিবর্তনের।
কিন্তু এখন ১৬ মাস পর মনে হচ্ছে, সেই প্রত্যাশার বেলুন কিছুটা চুপসে গেছে। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়গুলোতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দেশ। সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই অনুভূতি ক্রমাগত স্পষ্ট হচ্ছে।
ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আসলে সমাজেরই একটি অংশ, তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত একে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। গত ১৫ বছরে তৈরি হওয়া অলিগার্ক শ্রেণি থেকে দেশকে বের করে নিয়ে আসার কাজটা সহজ ছিল না। প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতকে পুনর্গঠন করা। মুষ্টিমেয় এক শ্রেণি যারা অর্থনীতির কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছিল, তাদের হাত থেকে উদ্ধারের পর পুনর্গঠন করে, অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর কাজটাও ছিল বেশ কঠিন।
পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, গত ১৬ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষত, ব্যাংকিং খাতে যে শোষণ চলছিল, তা অনেকটা কমানো সম্ভব হয়েছে।
ডলারের ওঠানামাটাও সামাল দেওয়া হয়েছে, যা কিছুদিন ধরে স্থির রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও ডলার রেট স্থির থাকার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। একদিকে বলা হচ্ছে, কিছুটা জোর করে ডলার রেট সীমার মধ্যে রাখা হয়েছে। আর এ জন্য আমদানি কিছুটা কমানো হয়েছে।
মোটকথা, গত ১৬ মাসে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেছে, যদিও এখনও দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশে চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে।
সমালোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে ভালো কাজগুলোও তুলে ধরা জরুরি। আমি এই সরকারের সেই ইতিবাচক দিক দিয়েই শুরু করছি। গত ১৬ মাসে অর্থনৈতিক খাতে সরকারের কিছু সফলতা দেখা গেছে, যার মধ্যে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
এর পাশাপাশি ব্যালেন্স অব পেমেন্টে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। যদিও বড় পরিবর্তন হয়নি, তবুও একটি নির্দিষ্ট ধরনের স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যাংকিং সেক্টর কিছু উন্নতি হলেও, ঋণ সুদের হার এখনও খুব বেশি। আমাদের দেশের সুদের হার প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।
একইসঙ্গে সাধারণ ব্যবসায়ীদের জীবনযাত্রা সহজীকরণ বা ‘ঈজ অব ডুয়িং বিজনেস’-এ বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনা যায়নি। দৈনন্দিন ব্যবসায়িক পথে যে অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়, সেখানে নতুন বা আরামদায়ক কোনো সংযোজন এখনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ব্যবসার পরিচালনা ব্যয় এখনও সেই পুরোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সত্যি বলতে গেলে, ব্যবসার খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যবসায়ীদের কষ্টও বেড়েছে। তাই বলা যায়, কস্ট-এর সঙ্গে কষ্টও বেড়েছে- অর্থাৎ প্রত্যাশিত সুবিধা পাওয়া এখনো সম্ভব হয়নি।
তার মানে ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ এখন হয়ে গেছে ‘কষ্ট অব ডুয়িং বিজনেস’। অথচ আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম আরও ভাল কিছু যার মাধ্যমে এই ‘কস্ট’ বা ‘কষ্ট’ দুটোই কমবে। কিন্তু গত ১৬ মাসে তা হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে।
হ্যাঁ, এটা বলার মতো যৌক্তিক কারণ আছে। আপনি যখন অনেক কিছু নিয়ে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, তখন অনেক কিছুতেই কঠোর হতে হয়েছে। আবার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক ভালো জিনিসও নষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকে। আর সেটাই এখানে হয়েছে।
এটার যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। যখন একসঙ্গে অনেক কাজ শুরু করা হয়, তখন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াই হয়ত প্রয়োজন হয়। তবে এসব বাস্তবায়নের সময় অনেক ভালো উদ্যোগও কিছুটা ব্যাহত হতে পারে। আমার মনে হয়, এই কঠোরতা বা বাধ্যবাধকতা প্রথম কয়েক মাস ঠিক ছিল, কিন্তু এরপর নীতিনির্ধারকদের কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজন ছিল।
একটি উদাহরণ দিই - ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহারের জন্য গ্যাসের সরবরাহে সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও নিরবচ্ছিন্ন ও গুণগত গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। গুণগত বলতে বোঝানো হচ্ছে - অনেক সময় সরবরাহ থাকে, কিন্তু এতই সীমিত যে, তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায় না। ইন্ডাস্ট্রির জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ যেমন নিরবচ্ছিন্ন হতে হবে, তেমনি প্রয়োজনীয় চাপও থাকতে হবে। এই নিশ্চয়তা এখনও সম্পূর্ণভাবে পাওয়া যায়নি।
সংক্ষেপে বলা যায়, কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেলেও, ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও সহজ ও স্থিতিশীল করার জন্য অনেক কাজ করার প্রয়োজন আছে।
১৬ মাসে সরকার কোনো বড় অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। তাদের হাতে সময়ও সীমিত। তাই নির্বাচনের আগে দৃষ্টিগোচর কোনো পরিবর্তন আশা করা বোকামি হবে।
তবে এই সরকারের কাছে ন্যূনতম প্রত্যাশা থাকতে পারে- গত ১৬ মাসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অন্তত কিছু ইতিবাচক কাজের সূচনা করা। যাতে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ এখনও কিছুটা স্থবির হয়ে আছে। এর অন্যতম কারণ হলো - আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যা এখনও অনেক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল। প্রতিদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যম এই অবনতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে। পাঁচই অগাস্ট পরবর্তী কিছুদিন এই পরিস্থিতির হয়ত যৌক্তিকতা ছিল, কিন্তু ১৬ মাস পরও যখন আগের মতোই রয়ে গেছে, তখন তা হতাশাজনক। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়; কারণ সবকিছুই নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সম্ভব ছিল, কিন্তু সরকার তা করতে পারেনি।
ক্রমাগত ঋণ সুদের হার বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রতুল সরবরাহ, আইনশৃঙ্খলার আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং বিদেশি বিনিয়োগের ঘাটতি - এসব অব্যাহত থাকায় ব্যবসা করাও দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এটি দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ফলে আমরা একটি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। রপ্তানিও গত দুই-তিন মাসে কিছুটা কমেছে। তবে এটি একমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ কারণে হয়নি; আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিও এর পিছনে বড় ভূমিকা রাখছে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমা দেশে বাসস্থান, জ্বালানি এবং অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সেখানে পোশাকের চাহিদা কমেছে, যা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের রপ্তানিতে প্রভাব ফেলেছে। এই অবস্থা সম্ভবত আগামী কয়েক মাস অব্যাহত থাকতে পারে।
কিছু ইতিবাচক দিকের মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি, যা মুদ্রা পাচার কমানো এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরে আসার প্রমাণ। কার্ব মার্কেটের চাহিদা কমায় ডলার এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের মধ্যেই প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে রপ্তানিতে ঘাটতি থাকলেও রেমিট্যান্সের ভালো প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় চাপ তৈরি করতে পারছে না। একই সঙ্গে আমদানি কমায় সরকারের ডলার খরচও কমেছে, যা রিজার্ভের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, চ্যালেঞ্জ থাকার পরও কিছু ইতিবাচক সূচকও দৃশ্যমান - যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আশা দেয়।
তবে দুঃখজনকভাবে আমরা দেখেছি, বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরা বেসরকারি খাতের ওপর পর্যাপ্ত আস্থা রাখতে পারেননি। গত ১৬ মাসে এই সেক্টরের সঙ্গে তেমন কোনো সমন্বিত আলোচনাও হয়নি। ফলে ব্যবসায়ীরাও নতুন বিনিয়োগে অনুপ্রাণিত হচ্ছে না। নীতিনির্ধারক ও প্রাইভেট সেক্টরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সুদৃঢ় না হলে অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগোতে পারে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। সত্যি বলতে, বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির চিত্রও প্রায় একইরকম। তাই বেসরকারি খাতকে উপেক্ষা বা কেবল সরকারি খাতকে প্রাধান্য দিলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।
আগের শাসনামলে কিছু অলিগার্ক শ্রেণি তৈরি হয়েছিল, যারা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। বর্তমান সরকারের উচিত এই শ্রেণিকে সাধারণ ব্যবসায়িদের থেকে আলাদা করে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা ও সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া। তবে এখানে কোথাও যেন কিছুটা ওভারল্যাপিং বা মিশ্র মূল্যায়ন দেখা যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের হয়ত দ্বিধা থাকতে পারে - কারা লুটেরা, আর কারা ভালো ব্যবসায়ী, তাই এটি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা জরুরি ছিল।
এদিকে সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যদি এটি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার প্রত্যাশা, বাকি যে কদিন সময় আছে, এর মধ্যেই সরকার যেন গত ১৬ মাসের ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে এবং যতটা সম্ভব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করার উদ্যোগ নেয়। এতে পরবর্তী সরকারের ওপরও একটি চাপ তৈরি হবে, যাতে তারা সেই সংস্কারকে আরও এগিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
সার্বিকভাবে বলা যায়, আমরা এক ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। ব্যবসায়িক সমাজ এখন নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের উদ্যোগের জন্য অপেক্ষায় আছে।
ফজলুল হক, বিকেএমইএ এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি, প্লামি ফ্যাশনস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
মতামত
ব্যবসায় ‘কস্ট’-এর সঙ্গে কষ্টও বেড়েছে
৫ই অগাস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর ষোল মাসে ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রত্যাশা কতটা পূরণ হয়েছে? লিখেছেন সাবেক বিকেএমইএ সভাপতি ও রপ্তানিমুখী পোশাক খাতের ব্যবসায়ী ফজলুল হক।
পাঁচই অগাস্টের পর আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি- শুধু ব্যবসায়ী না, সাধারণ মানুষও সেই প্রত্যাশায় অংশগ্রহণ করেছিল। কারণ গণঅভ্যুত্থানের পর যে সরকারই আসুক, তাদের কাছে জনগণের আশা থাকে পরিবর্তনের।
কিন্তু এখন ১৬ মাস পর মনে হচ্ছে, সেই প্রত্যাশার বেলুন কিছুটা চুপসে গেছে। বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য বিষয়গুলোতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দেশ। সাধারণ নাগরিকের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই অনুভূতি ক্রমাগত স্পষ্ট হচ্ছে।
ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আসলে সমাজেরই একটি অংশ, তবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত একে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। গত ১৫ বছরে তৈরি হওয়া অলিগার্ক শ্রেণি থেকে দেশকে বের করে নিয়ে আসার কাজটা সহজ ছিল না। প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতকে পুনর্গঠন করা। মুষ্টিমেয় এক শ্রেণি যারা অর্থনীতির কিছু অংশ নিয়ন্ত্রণ করছিল, তাদের হাত থেকে উদ্ধারের পর পুনর্গঠন করে, অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর কাজটাও ছিল বেশ কঠিন।
পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে, গত ১৬ মাসে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষত, ব্যাংকিং খাতে যে শোষণ চলছিল, তা অনেকটা কমানো সম্ভব হয়েছে।
ডলারের ওঠানামাটাও সামাল দেওয়া হয়েছে, যা কিছুদিন ধরে স্থির রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও ডলার রেট স্থির থাকার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। একদিকে বলা হচ্ছে, কিছুটা জোর করে ডলার রেট সীমার মধ্যে রাখা হয়েছে। আর এ জন্য আমদানি কিছুটা কমানো হয়েছে।
মোটকথা, গত ১৬ মাসে কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেছে, যদিও এখনও দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশে চ্যালেঞ্জ রয়েই গেছে।
সমালোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে ভালো কাজগুলোও তুলে ধরা জরুরি। আমি এই সরকারের সেই ইতিবাচক দিক দিয়েই শুরু করছি। গত ১৬ মাসে অর্থনৈতিক খাতে সরকারের কিছু সফলতা দেখা গেছে, যার মধ্যে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধি একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
এর পাশাপাশি ব্যালেন্স অব পেমেন্টে কিছুটা স্থিতিশীলতা এসেছে। যদিও বড় পরিবর্তন হয়নি, তবুও একটি নির্দিষ্ট ধরনের স্থিতিশীলতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
অন্যদিকে ব্যাংকিং সেক্টর কিছু উন্নতি হলেও, ঋণ সুদের হার এখনও খুব বেশি। আমাদের দেশের সুদের হার প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় সর্বোচ্চ পর্যায়ে রয়েছে।
একইসঙ্গে সাধারণ ব্যবসায়ীদের জীবনযাত্রা সহজীকরণ বা ‘ঈজ অব ডুয়িং বিজনেস’-এ বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনা যায়নি। দৈনন্দিন ব্যবসায়িক পথে যে অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়, সেখানে নতুন বা আরামদায়ক কোনো সংযোজন এখনও লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ বা ব্যবসার পরিচালনা ব্যয় এখনও সেই পুরোনো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সত্যি বলতে গেলে, ব্যবসার খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি ব্যবসায়ীদের কষ্টও বেড়েছে। তাই বলা যায়, কস্ট-এর সঙ্গে কষ্টও বেড়েছে- অর্থাৎ প্রত্যাশিত সুবিধা পাওয়া এখনো সম্ভব হয়নি।
তার মানে ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ এখন হয়ে গেছে ‘কষ্ট অব ডুয়িং বিজনেস’। অথচ আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম আরও ভাল কিছু যার মাধ্যমে এই ‘কস্ট’ বা ‘কষ্ট’ দুটোই কমবে। কিন্তু গত ১৬ মাসে তা হয়নি, বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেড়ে গেছে।
হ্যাঁ, এটা বলার মতো যৌক্তিক কারণ আছে। আপনি যখন অনেক কিছু নিয়ে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন, তখন অনেক কিছুতেই কঠোর হতে হয়েছে। আবার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে অনেক ভালো জিনিসও নষ্ট হওয়ার সুযোগ থাকে। আর সেটাই এখানে হয়েছে।
এটার যৌক্তিক ব্যাখ্যা আছে। যখন একসঙ্গে অনেক কাজ শুরু করা হয়, তখন কঠোর পদক্ষেপ নেওয়াই হয়ত প্রয়োজন হয়। তবে এসব বাস্তবায়নের সময় অনেক ভালো উদ্যোগও কিছুটা ব্যাহত হতে পারে। আমার মনে হয়, এই কঠোরতা বা বাধ্যবাধকতা প্রথম কয়েক মাস ঠিক ছিল, কিন্তু এরপর নীতিনির্ধারকদের কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজন ছিল।
একটি উদাহরণ দিই - ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহারের জন্য গ্যাসের সরবরাহে সামান্য উন্নতি হয়েছে। তবে এখনও নিরবচ্ছিন্ন ও গুণগত গ্যাস ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। গুণগত বলতে বোঝানো হচ্ছে - অনেক সময় সরবরাহ থাকে, কিন্তু এতই সীমিত যে, তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায় না। ইন্ডাস্ট্রির জন্য গ্যাস-বিদ্যুতের সরবরাহ যেমন নিরবচ্ছিন্ন হতে হবে, তেমনি প্রয়োজনীয় চাপও থাকতে হবে। এই নিশ্চয়তা এখনও সম্পূর্ণভাবে পাওয়া যায়নি।
সংক্ষেপে বলা যায়, কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ দেখা গেলেও, ব্যবসায়িক পরিবেশকে আরও সহজ ও স্থিতিশীল করার জন্য অনেক কাজ করার প্রয়োজন আছে।
১৬ মাসে সরকার কোনো বড় অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। তাদের হাতে সময়ও সীমিত। তাই নির্বাচনের আগে দৃষ্টিগোচর কোনো পরিবর্তন আশা করা বোকামি হবে।
তবে এই সরকারের কাছে ন্যূনতম প্রত্যাশা থাকতে পারে- গত ১৬ মাসের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে অন্তত কিছু ইতিবাচক কাজের সূচনা করা। যাতে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে বাধ্য হয়।
বর্তমানে দেশে বিনিয়োগ এখনও কিছুটা স্থবির হয়ে আছে। এর অন্যতম কারণ হলো - আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, যা এখনও অনেক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল। প্রতিদিনই বিভিন্ন গণমাধ্যম এই অবনতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করছে। পাঁচই অগাস্ট পরবর্তী কিছুদিন এই পরিস্থিতির হয়ত যৌক্তিকতা ছিল, কিন্তু ১৬ মাস পরও যখন আগের মতোই রয়ে গেছে, তখন তা হতাশাজনক। এটি কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়; কারণ সবকিছুই নিয়ম ও শৃঙ্খলার মধ্যে আনা সম্ভব ছিল, কিন্তু সরকার তা করতে পারেনি।
ক্রমাগত ঋণ সুদের হার বৃদ্ধি, গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রতুল সরবরাহ, আইনশৃঙ্খলার আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দুর্নীতি এবং বিদেশি বিনিয়োগের ঘাটতি - এসব অব্যাহত থাকায় ব্যবসা করাও দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এটি দেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ফলে আমরা একটি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। রপ্তানিও গত দুই-তিন মাসে কিছুটা কমেছে। তবে এটি একমাত্র দেশের অভ্যন্তরীণ কারণে হয়নি; আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতিও এর পিছনে বড় ভূমিকা রাখছে। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমা দেশে বাসস্থান, জ্বালানি এবং অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সেখানে পোশাকের চাহিদা কমেছে, যা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের রপ্তানিতে প্রভাব ফেলেছে। এই অবস্থা সম্ভবত আগামী কয়েক মাস অব্যাহত থাকতে পারে।
কিছু ইতিবাচক দিকের মধ্যে রয়েছে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি, যা মুদ্রা পাচার কমানো এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থায় আস্থা ফিরে আসার প্রমাণ। কার্ব মার্কেটের চাহিদা কমায় ডলার এখন ব্যাংকিং চ্যানেলের মধ্যেই প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে রপ্তানিতে ঘাটতি থাকলেও রেমিট্যান্সের ভালো প্রবাহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় চাপ তৈরি করতে পারছে না। একই সঙ্গে আমদানি কমায় সরকারের ডলার খরচও কমেছে, যা রিজার্ভের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সংক্ষেপে বলা যায়, চ্যালেঞ্জ থাকার পরও কিছু ইতিবাচক সূচকও দৃশ্যমান - যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য আশা দেয়।
তবে দুঃখজনকভাবে আমরা দেখেছি, বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকরা বেসরকারি খাতের ওপর পর্যাপ্ত আস্থা রাখতে পারেননি। গত ১৬ মাসে এই সেক্টরের সঙ্গে তেমন কোনো সমন্বিত আলোচনাও হয়নি। ফলে ব্যবসায়ীরাও নতুন বিনিয়োগে অনুপ্রাণিত হচ্ছে না।
নীতিনির্ধারক ও প্রাইভেট সেক্টরের ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা সুদৃঢ় না হলে অর্থনীতি দ্রুতগতিতে এগোতে পারে না। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। সত্যি বলতে, বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির চিত্রও প্রায় একইরকম। তাই বেসরকারি খাতকে উপেক্ষা বা কেবল সরকারি খাতকে প্রাধান্য দিলে অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হতে পারে।
আরও পড়ুন: ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন কোটিপতিরা
আগের শাসনামলে কিছু অলিগার্ক শ্রেণি তৈরি হয়েছিল, যারা অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। বর্তমান সরকারের উচিত এই শ্রেণিকে সাধারণ ব্যবসায়িদের থেকে আলাদা করে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করা ও সেই মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া। তবে এখানে কোথাও যেন কিছুটা ওভারল্যাপিং বা মিশ্র মূল্যায়ন দেখা যাচ্ছে। নীতিনির্ধারকদের হয়ত দ্বিধা থাকতে পারে - কারা লুটেরা, আর কারা ভালো ব্যবসায়ী, তাই এটি স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করা জরুরি ছিল।
এদিকে সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে না। যদি এটি দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে সামগ্রিক অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে। আমার প্রত্যাশা, বাকি যে কদিন সময় আছে, এর মধ্যেই সরকার যেন গত ১৬ মাসের ঘাটতি কিছুটা হলেও পূরণ করতে পারে এবং যতটা সম্ভব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবান করার উদ্যোগ নেয়। এতে পরবর্তী সরকারের ওপরও একটি চাপ তৈরি হবে, যাতে তারা সেই সংস্কারকে আরও এগিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
সার্বিকভাবে বলা যায়, আমরা এক ধরনের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। ব্যবসায়িক সমাজ এখন নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের উদ্যোগের জন্য অপেক্ষায় আছে।
ফজলুল হক, বিকেএমইএ এবং বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সাবেক সভাপতি, প্লামি ফ্যাশনস-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক।