মতামত

বুদ্ধিজীবিতা, ভিউজীবিতা ও বিদ্যা-বুদ্ধির দ্বন্দ্ব

আপডেট : ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৪:৫২ পিএম

বাংলা ভাষায় আমরা বিদ্যা ও বুদ্ধিকে যুক্ত করে ‘বিদ্যাবুদ্ধি’ বলি। বুদ্ধিজীবীরা বুদ্ধিজীবী হন নিজেদের ওই বিদ্যাবুদ্ধির জোরেই— তাদের বিদ্যা থাকে, থাকতেই হবে, নইলে বুদ্ধিজীবী কীভাবে? বিদ্যা হলো অধ্যয়ন বা শিক্ষার মাধ্যমে লব্ধজ্ঞান, যা পুস্তকপাঠ থেকে আসে, আড্ডা থেকে আসে, জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আসে। বিদ্যারই অপর নাম জ্ঞান। কিন্তু শুধু বিদ্যাই কি মানুষকে বুদ্ধিজীবী করে?

তা নয়। বিদ্বান মাত্রই বুদ্ধিজীবী হন না, যদিও বুদ্ধিজীবী হলে বিদ্বান হতেই হয়। বিদ্বানরা পন্ডিত হন, দক্ষ হন, পেশাজীবী হন, বিশেষজ্ঞও হয়ে থাকেন; কিন্তু এসব হওয়া আর বুদ্ধিজীবী হওয়া এক ব্যাপার নয়।

বুদ্ধি বেচে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের বুদ্ধিজীবী বলা হলেও বিষয়টা এত জলবৎ তরলং নয় আসলে; প্রকৃত বিচারে এমন একদল ব্যক্তিকে বুদ্ধিজীবী বলা হয়, যারা সমাজের জটিল সমস্যাবলির সমাধান দেন, চিন্তাভাবনা করে দিকনির্দেশনাও দেন।

বুদ্ধিজীবীরাই সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে মননশীল বিশ্লেষণ ও গবেষণা করেন এবং তাদের ভাবনাচিন্তা সমাজকে প্রভাবিত করে। বুদ্ধিজীবীরা তাদের সময়ের নৈতিকতাকে, চেতনাকে বিনির্মাণ করেন, সমাজ ও রাজনীতিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং স্বাধীনভাবে নিজেদের চেতনা অনুযায়ী এসব বিষয়ে মত বা অমত দেন। আরও কিছু করতে পারা বুদ্ধিজীবী হওয়ার জন্য আবশ্যক, আর তা হচ্ছে সমাজের কল্যাণে বুদ্ধির প্রয়োগ। বিদ্যা ও বুদ্ধি উভয়ের প্রয়োগ থাকা চাই, এই দুই শক্তি একে অপরের পরিপূরক বলে গণ্য; তবে বুদ্ধিজীবীর ক্ষেত্রে এ দুয়ের সম্পর্ক দ্বান্দিক। কার্যকর চিন্তনকাঠামোতে বিদ্যা ও বুদ্ধি দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকবে, তারা একে অপরের বিরুদ্ধে লড়বে, কিন্তু কেউ কাউকে ধ্বংস করবে না, তাড়িয়েও দেবে না, তার মানে দ্বন্দ্বটা হবে ইতিবাচক। এ লড়াইয়ে সৃষ্টিশীলতা বিকশিত হবে। যিনি বুদ্ধিজীবী, কাঙ্ক্ষা করা হয় যে, তিনি হবেন মানবিক, গণতান্ত্রিক, মুক্তমনা এবং জনতার ও সমাজের মঙ্গলকামী। তিনি হবেন অন্যায়—অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসনের বিরোধী। তিনি কথা বলবেন জনগণের পক্ষে, থাকবেন শান্তি, ন্যায়, কল্যাণ ও সত্যের সঙ্গে।

বুদ্ধিজীবীর জন্য বুদ্ধির প্রয়োগটাই মূল কাজ হওয়ার কথা। বুদ্ধির সাহায্যে পৃথিবীকে তারা ব্যাখ্যা করবেন—এটাই কাম্য। তবে সেটাই তাদের একমাত্র কাজ নয়। অপরিহার্য থাকে আরেকটি কাজ, সেটা হলো পৃথিবীটাকে পাল্টে দেওয়া। অন্যায়—অনাচার, সুবিধাবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিদ্যমান ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করা, তার অসম্পূর্ণতাকে মেনে না নেওয়া। পরিবর্তনের বুদ্ধি দেওয়াও বুদ্ধিজীবীর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। 

এসব কাজ একা করা যায় না, বুদ্ধিজীবী সেটা জানেন এবং জানেন বলেই বুদ্ধিজীবী দলবদ্ধ হন। বুদ্ধিজীবী সংগ্রহ করেন, তিনি বিজ্ঞ; কিন্তু যা সংগ্রহ করেন তাকে তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজনে ও অভিভাবকত্বে নতুন করে তোলেন। তিনি ফ্যানসিফুল বা সার্কাস্টিক নন, তিনি ইমাজিনেটিভ— কল্পনাপ্রবণ। তিনি হৃদয়বানও বটে। হৃদয়বান না হলে অন্যের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ও যুক্ত হয়ে পৃথিবীটাকে বদলানোর প্রেরণা তিনি পাবেন কোথা থেকে? কোনো বুদ্ধিজীবীই বুদ্ধিজীবী নন, যদি না তিনি হৃদয়বান হন। দ্বন্দ্ব থাকে বুদ্ধি ও বিদ্যার মধ্যে, ইতি—নেতি থাকে হৃদয়ে।

কবিরা বুদ্ধিজীবী, কারণ তারা স্বপ্ন দেখান— ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক। এক সময় ছিল যখন বুদ্ধিজীবীরা দার্শনিকের ভূমিকা পালন করতেন। তারা প্রশ্ন করতেন, ব্যাখ্যা করতেন; তাদের লক্ষ্য থাকত প্রতিষ্ঠিত মতকে বদলানোর। দার্শনিকরা তখন বিজ্ঞানীর দায়ভারটাও নিতেন।

জ্ঞানকান্ডের বিকাশের প্রয়োজনেই বিভাজন এসেছে পৃথিবীতে— দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকের অভেদ ভেঙে গেছে; বৈজ্ঞানিকরা শক্তিশালী হয়েছেন, দার্শনিকরা কিছুটা পিছু হটেছেন। দর্শন ও বিজ্ঞানের বিচ্ছিন্নতার এই জায়গায় ডাক পড়েছে বুদ্ধিজীবীর, তারা বিজ্ঞানমনস্ক, তবে বিশেষজ্ঞ নন। তারা প্রশ্নও করেন। ভাববিলাসের জন্য নয়, দার্শনিকভাবে বোঝার ও ব্যবস্থা পাল্টানোর জন্য।

কারা প্রকৃত বুদ্ধিজীবী? এই প্রশ্ন যেমন আছে, তেমনি আছে উত্তরের পাহাড়; সমুদ্রসমান চিন্তা ও তর্ক বুদ্ধিজীবীদের। দুনিয়ার তাবড় তাবড় চিন্তক তাদের চিন্তা—উগারী মস্তিষ্কখাদ্য রেখে গেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। ফরাসি ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক জুলিয়া বেঁদার বহু ব্যবহৃত বাক্যটিই আগে স্মরণ করি— ‘প্রকৃত বুদ্ধিজীবী’ তারাই যারা জাগতিক লাভের ঊর্ধ্বে উঠে নিঃস্বার্থ এবং আপসহীন জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত থাকেন— সত্য উচ্চারণে নির্ভীক থাকেন, এমনকি সত্য প্রকাশের জন্য প্রাণ সংশয়ের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধা করেন না, বরং জাতির সংকটে নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। 

ইতালীয় মার্কসবাদী তাত্ত্বিক আন্তোনিও গ্রামসি ট্র্যাডিশনাল বা ঐতিহ্যগত বুদ্ধিজীবিতাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে বলেছিলেন—শিক্ষক, যাজক, পুরোহিত, ইমাম, চিকিৎসকদের কথা; পাশাপাশি তিনি আরেক দল অর্গানিক বা স্বগত—স্বজাত বুদ্ধিজীবীর কথা বলেছিলেন, যারা সবসময় যার যার শ্রেণিগত অবস্থানে থেকেই জগৎকে পুঁজিবাদ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করেন।

ফিলিস্তিনি সাহিত্য সমালোচক ও তাত্ত্বিক এডওয়ার্ড সাঈদ মনে করতেন, ‘বুদ্ধিজীবী এমন একজন ব্যক্তি যিনি স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচারের পক্ষে একটি নির্দিষ্ট বার্তা, একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও একটি সুচিন্তিত মত জনগণের সামনে হাজির করেন। কোনো প্রতিবন্ধকতাই তাকে সত্য প্রকাশ থেকে বিচ্যুত করতে পারে না।’

চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি বুদ্ধিজীবীর দায়বদ্ধতা প্রসঙ্গে আরও পরিষ্কারভাবে বলেছেন, ‘বুদ্ধিজীবীর দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারের মিথ্যাগুলোকে জনগণের সামনে উন্মোচন করা। বুদ্ধিজীবীরা যে কোনো পেশারই হতে পারেন। অধ্যাপক, গবেষক, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, শিল্পবোদ্ধা, আইনজীবী বা রাজনীতির আলোচক।’

বুদ্ধিজীবী কোনো উপাধি নয়, পেশাও নয়, এমনকি এটি স্বভাবজাত বিষয়ও নয় বরং অনেকটাই হয়ে ওঠার ব্যাপার। জ্ঞানে, কর্মে, মননে, চিন্তায় এবং তার প্রকাশের চর্চার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠেন।  

বুদ্ধিজীবীরা যখন থেকে তাদের দায়িত্বের স্বরূপ ভুলে, নিজেদের স্বাধীন ও শক্তিশালী মতপ্রকাশের অবস্থান থেকে পিছু হটলেন, যখন থেকে তারা চোখের সামনে অন্যায়—অবিচার ঘটতে দেখেও নীরব থাকলেন এবং নীতি—নৈতিকতা ভুলে ক্ষমতাসীনদের অন্যায় আচরণের সঙ্গে সুর মেলালেন তখন থেকেই তাদের অসম্মানের শুরু। ১৯৭২ সালে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাসে আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা সুবিধাবাদী। তারা নিজেদের আখের গোছাতেই বেশি ব্যস্ত, সমাজের কল্যাণ সাধন তাদের উদ্দেশ্য নয়। মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে তারা নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধি ব্যয় করতে আগ্রহী নন। নিজের স্বার্থের বাইরে তারা একচুলও নড়েন না।’  

উদ্বেগজনক বিষয় হলো, বুদ্ধিজীবিতার মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানটাই এখন পাল্টে গেছে। এখন জনগণ বুদ্ধিজীবী ধারণাটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে থাকেন। মানুষের কাছে বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই বললেই চলে। কারণ, এখন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার ওপর নির্ভর করে বুদ্ধিজীবীর পরিচয়।

যে দলেরই হোক বুদ্ধিজীবীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য জাতিকে পরামর্শ ও বুদ্ধি দেওয়া, সেখানে বিবেচনায় দল নয়, গুরুত্বপূর্ণ দেশ, দেশের মানুষ, দলমত নির্বিশেষ মানুষের অধিকার; অধিকার ক্ষুণ্ণ করার মতো কিছু দেখলেই তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা। বুদ্ধিজীবীর কাজ প্রশ্ন করা। সে প্রশ্ন রাষ্ট্র ও সমাজ নিতে পারে কি না সে যাচাইয়ের ভারও অবশ্য আপনার। যাচাইটি করতে পারলে আপনি বুঝবেন, কেন এই সমাজ বুদ্ধিজীবীহীন, কেন এই সমাজ প্রশ্নহীন।

এই সমাজের গণমাধ্যম মেতে আছে ভিউবাণিজ্য নিয়ে, পরিশ্রমসাধ্য অর্জন করা জ্ঞানের ঋদ্ধ মানুষের কদরের চেয়ে তথাকথিত ‘হিট খাওয়া’, ‘মুখে মুখে ফেরা’, ‘বাণিজ্যসফল’ কন্টেন্ট ক্রিয়েটরের কদর এখন বেশি। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও এমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না যে এই ম্যাসহিস্টিরিয়ার বিপরীতে চিন্তাচর্চার দিকে পপুলারম্যাসকে টেনে আনবেন। ফলে দিনশেষে অসহিষ্ণু রাজনীতির প্রভাবের বাইরে থাকা তরুণ সমাজও শর্ট রিলস আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মুহূর্তেও টোটকাতেই অভ্যস্ত হচ্ছে। এই ভিউজীবিতার যুগে বুদ্ধিজীবীতা যে এখনো টিকে আছে, সেও এক আশ্চর্য। 

সে জন্যই চাওয়া, বুদ্ধির মুক্তি ঘটুক। বুদ্ধিজীবীর কোনো দল নেই, গণমানুষ তার দল। মানুষের অধিকারের কথাই তার একমাত্র সেস্নাগান। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করাই তার কাজ। আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান কাজ হওয়া উচিত বুদ্ধিজীবীর বলার জায়গা তৈরি করা। তার বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা। তর্কের জায়গা তৈরি করা। আমাদের রাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি ব্যর্থ এ জায়গাতেই। জাতির সংকটে—দেশপ্রেমের প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীরা কতটা ভূমিকা রাখতে পারে, তার উদাহরণ আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা।

তথ্যসূত্র:

১. বুদ্ধিজীবীর দায়/ আজিজুল রাসেল/ এনটিভি অনলাইন/৯ মার্চ, ২০১৫

২. বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস/ আহমদ ছফা/ মুক্তধারা ১৯৭২

৩. কে বুদ্ধিজীবী/ শাহনাজ মুন্নী/ ডিডব্লিউবাংলা

 

শিমুল সালাহ্উদ্দিন

লেখক, কবি, সাংবাদিক ও গবেষক

এই লেখায় প্রকাশিত মতামত লেখকের সম্পূর্ণ নিজের।