বিপন্ন গণমাধ্যম, বিপন্ন বাংলাদেশ, মবের শেষ কোথায়

সংবাদমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা আক্রান্ত হলে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার প্রসঙ্গ বারবার আসে, যেখানে বলা হয়েছে, “প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের, এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।” 

কিন্তু আসলেই কি সংবাদমাধ্যমের সেই স্বাধীনতা আছে? সাংবাদিক ও নাগরিকরা কি নির্ভয়ে বাক ও ভাবপ্রকাশ করতে পারেন?

প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ছায়ানট ও উদীচীতে হামলা এবং খুলনা ও ময়মনসিংহে সাংবাদিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু দুজনকে হত্যার ঘটনায় এই প্রশ্নগুলো আরও তীব্রভাবে সামনে এসেছে।

শেখ হাসিনার দেড় দশকের টানা শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের লড়াই ছিল অবিরাম, সরকারের রোষানলে ছিল প্রতিষ্ঠান দুটি। শুধু শেখ হাসিনার শাসনামলেই নয়, জন্মের পর থেকে সব সরকারের আমলেই ক্ষমতাকে প্রশ্ন করেছে।  

জুলাই অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ায়, জনগণের প্রত্যাশা ছিল, দেশের গণমাধ্যমগুলো স্বাধীন সাংবাদিকতা করতে পারবে।

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম প্রফেসর ইউনূসের ঘনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে পরিচিত।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে দেশের শীর্ষ দুই সংবাদমাধ্যম - সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, অভিনব এক প্রতিবন্ধকতা।

‘ভারতীয় দালাল’ আখ্যা দিয়ে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে হামলাযোগ্য করে তুলতে ক্রমাগত উসকানি শুরু হয়। অভিযোগ আছে, যার অগ্রভাগে আছেন - প্রবাসী দুই ইউটিউবার। 

তাদের অবিরাম উসকানির সঙ্গে যুক্ত হয় দেশের ভেতরের কেউ কেউ - যারা মূলত ‘উগ্র ডানপন্থি’ হিসেবে পরিচিত। 

শরিফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর প্রচার হবার পর বৃহস্পতিবার গভীর রাতে নজিরবিহীন হামলা চালানো হয় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নাকের ডগায় লুটপাট, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চলে কয়েকঘণ্টা ধরে। 

একই রাতে হামলা ও লুটপাট হয় ছায়নট-এ; ১৯৬১ সাল থেকে বাংলা সংস্কৃতির অন্যতম পীঠস্থান হিসেবে পরিচিত এই প্রতিষ্ঠান। 

বাংলা ভাষা, জাতীয় সঙ্গীত এবং সর্বোপরি সাংস্কৃতিক ও সংগীত ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে ছয় দশকের বেশি সময় নিরন্তর কাজ করে আসছে ছায়ানট। 

পরেরদিন একই ঘটনা ঘটে দেশের বৃহত্তম সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কার্যালয়ে।

উদীচীর বয়সও ছয় দশকের বেশি এবং শুরু থেকেই তারা মানুষের অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্যের সমাজ বিনির্মাণের সংগ্রামে লিপ্ত। 

এসব প্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্য হামলার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ঘটনাস্থলে থাকলেও, কার্যত তারা ছিলেন ‘নিষ্ক্রিয়’ ও ‘দর্শকের’ ভূমিকায়। যে কারণে হামলাকারীরা দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে তাণ্ডব চালায়।  

শীর্ষ দুই গণমাধ্যমে হামলার ঘটনার দিন আলোচিত আরও দুটি হত্যাকাণ্ড ঘটে দেশের দুই জায়গায়। 

ময়মনসিংহের ভালুকায় হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন পোশাক শ্রমিককে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির অজুহাত দেখিয়ে দলবদ্ধভাবে পিটিয়ে ও পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। 

কাছাকাছি সময়ে খুলনায় গুলি করে হত্যা করা হয় ইমদাদুল হক মিলন নামে একজন সাংবাদিককে।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা এই উগ্র গোষ্ঠী আসলে কারা? ওসমান হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেন তারা এসব প্রতিষ্ঠান টার্গেট করল?  

বাংলাদেশ কাদের কব্জায়? 

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা করার ঘোষণা আগেই দেওয়া হয়েছে এবং ভাঙচুর, লুটপাট ও আগুন দেওয়া হয়েছে প্রকাশ্যে। 

ঘটনার পর প্রধান উপদেষ্টার ফেইসবুক পেইজে অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। 

“কয়েকজন বিচ্ছিন্ন উগ্র গোষ্ঠীর দ্বারা সংঘটিত সকল প্রকার সহিংসতার বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে সতর্ক থাকুন।” 

সরকারের পক্ষ থেকে বলা এই উগ্র গোষ্ঠী আসলে কারা? ওসমান হাদির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে কেন তারা এসব প্রতিষ্ঠান টার্গেট করল? 

“ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলার ঘটনার সরাসরি সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না,” আলাপ-কে বলেন নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল।

তাসনিম খলিল অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। শেখ হাসিনার শাসনামলে সুইডেনে বসে নেত্র নিউজ নামে একটি অনুসন্ধানী গণমাধ্যম পরিচালনা করতেন। সেখানে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের নানা দুর্ণীতি অনিয়ম নিয়ে আলোচিত বহু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। 

‘আয়নাঘর’ নামের এক গোপন বন্দিশালা নিয়ে নেত্র নিউজের একটি প্রতিবেদন ব্যাপক সাড়া ফেলে দিয়েছিল।

তাসনিম খলিল বলেন, “এই সরকার আসার পর থেকে মব হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের উসকানি হচ্ছে। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার আগে থেকেই হুমকির মধ্যে ছিল; হাদির মৃত্যুর কারণে এই হামলা হয়নি।”

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর কয়েকদফায় প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে বিভিন্ন ব্যানারে জড়ো হয়েছিল ‘মব’। একবার ’জেয়াফত’ বা ভোজসভার আয়োজন করা হয়, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় সেবার তা করতে পারেনি। 

দেশের শীর্ষ দুটি গণমাধ্যমে হামলার কারণ খুঁজেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। নেত্র নিউজ, আলজাজিরা ও দ্য ইকনোমিস্টসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে বেশকিছু সাড়া জাগানো প্রতিবেদন করেছেন এই সাংবাদিক।

“ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাপক ক্ষোভ উসকে দিয়েছে দেশের ভেতর ও বাইরে থাকা কিছু রাজনৈতিক শক্তি - বিশেষত ইসলামি ‘বিপ্লবী’ ডানপন্থি মহল। এসব শক্তি যে ইস্যুটিকে সামনে এনে তাদের সমালোচনা করছে, তা হলো- তাদের অবস্থান নাকি ‘ভারতপন্থি’।

“কিন্তু বাস্তবে ক্ষোভের মূল কারণ হলো - এই পত্রিকাগুলো ধর্মনিরপেক্ষ ও তথ্যভিত্তিক গণমাধ্যম; যাদের সঙ্গে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনা’ এবং পূর্বাপর দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত,” আলাপ-কে বলেন তিনি। 

এবার এমন চারটি প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়েছে, যাদের শেকড় লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভেতরে। এর আগেও আক্রান্ত হয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। 

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দিচ্ছেন ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম।

ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম মনে করেন দেশ, সাংবাদিকতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। 

আলাপ-কে তিনি টেলিফোনে বলেন, “ডেইলি স্টার একটা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু স্বাধীন সাংবাদিকতা হচ্ছে একটা ফিলসফি বা দর্শন।”

“দেশ, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতার স্বার্থেই স্বাধীন সাংবাদিকতার দর্শনকে সমুন্নত রাখতে হবে। এ বিষয়ে ছাড় দেবার কোনো সুযোগ নেই।”

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ দেখছেন বিশ্লেষকরা। এরমধ্যে অন্যতম হলো- তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা। 

বাংলাদেশের গণমাধ্যমের ইতিহাসে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে সাংবাদিকতা করতে পেরেছে এবং এ কারণে তারা অন্য গোষ্ঠীর টার্গেটেও পরিণত হয়েছে বলে মনে করেন নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক তাসনিম খলিল।

“পেশাদার ও মুক্ত বা ইনডিপেনডেন্ট গণমাধ্যম বলতে আমরা যা বুঝি – বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর মধ্যে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার নিজেরাই ব্যবসা করে ওই জায়গায় দাঁড়াতে পেরেছে।”

তাসনিম খলিল বলেন, “দক্ষিণপন্থি বা ইসলামপন্থিদের যত আপত্তি থাকুক, দক্ষিণপন্থিরা ওইরকম পেশাদার প্রতিষ্ঠান গড়তে পারছেন না। আমার দেশ – যে পত্রিকাকে প্রথম আলোর প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন তারা, সেই পত্রিকাটির সাংবাদিকতা ওই মানের নয়।”

তাসনিম খলিল অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে পরিচিত। শেখ হাসিনার শাসনামলে সুইডেনে বসে নেত্র নিউজ নামে একটি অনুসন্ধানী গণমাধ্যম পরিচালনা করতেন।

ডানপন্থিদের দৌরাত্ম্য শুধু দেশেই নয়, রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোতেও। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের প্রসঙ্গও তুলে ধরেন নেত্র নিউজের প্রধান সম্পাদক।

“যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা যায় – ফার-রাইট বা উগ্র ডানপন্থি লোকজন ফ্রি মিডিয়া পছন্দ করেন না।”

তিনি বলেন, “উগ্র দক্ষিণপন্থিরা মনে করেন, তাদের মতো করে থাকতে হবে, তাদের মতো হতে হবে।”

বহুত্ববাদী বা গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনে যারা অন্তরায়, তারাই গণমাধ্যমে হামলার ঘটনার মতো কাজগুলো ঘটান বলে মনে করেন তাসনিম খলিল।

প্রায় আড়াইশো বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসন বলেছিলেন, “আমাদের স্বাধীনতা নির্ভর করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর। সেটিকে সীমাবদ্ধ করা হলে স্বাধীনতাও টিকে থাকে না।”

জেফারসনের এই কথাগুলো এখনও প্রাসঙ্গিক। পশ্চিমা বিশ্বে এই চর্চা নিয়মিত। সেখানে ডানপন্থিরা গণমাধ্যমের ‘গলা চেপে’ ধরতে গেলেও উদারনৈতিক সমাজ ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের সমালোচনায় মুখে সফল হয় না। 

কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন না। এর মূল কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রকেই দায়ী করেন।

দুই পত্রিকার সাংবাদিকরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সহায়তার আবেদন করলেও সাড়া মেলেনি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেইসবুক পোস্টে নিজের অসহায়ত্বের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। 

উশৃঙ্খল মবের সামনে অসহায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

সহিংসতার আগুনে ডেইলি স্টার ভবন যখন পুড়ছিল, তখন ভেতরে আটকে পড়া সাংবাদিকদের অসহায়ত্ব, আতঙ্ক ও সহায়তার হাহাকার প্রকাশ্যে আসে - যা ঘটনার ভয়াবহতা ব্যাপকভাবে ফুটিয়ে তোলে। 

তাদের উদ্ধার করতে লেগে যায় কয়েক ঘণ্টা। হামলায় প্রথম আলোর একটি ভবন ও ডেইলি স্টারের কার্যালয় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। প্রায় ১০ ঘণ্টার চেষ্টায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে আগুন।

শুক্রবার প্রকাশিত হয়নি পত্রিকা দুটো, অনলাইন কার্যক্রমও বন্ধ থাকে কয়েকঘণ্টা। 

দেশের শীর্ষ সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান ‘সম্পাদক পরিষদ’-এর সভাপতি এবং নিউ এইজের সম্পাদক নুরুল কবীর ওই রাতে ডেইলি স্টারে ছুটে যান। তার ওপরও হামলা চালানো হয়। 

দুই পত্রিকার সাংবাদিকরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সহায়তার আবেদন করলেও সাড়া মেলেনি। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ফেইসবুক পোস্টে নিজের অসহায়ত্বের কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। 

“গত রাতে দ্য ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর আমার সাংবাদিক বন্ধুদের কাছ থেকে সাহায্যের জন্য ভাঙা গলা ও কান্নাভেজা ফোন পেয়েছি। আমার সব বন্ধুদের কাছে আমি গভীরভাবে দুঃখিত - আমি তোমাদের পাশে দাঁড়াতে পারিনি। সঠিক মানুষদের কাছে পৌঁছাতে, সহায়তা জোগাড় করতে আমি অসংখ্য ফোন করেছি, কিন্তু সময়মতো তা পৌঁছায়নি”, ফেসবুকে লেখেন শফিকুল আলম।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারে হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের আগে গোয়েন্দা তথ্য সরকার কেন আমলে নেয়নি, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ।

“রাষ্ট্র কাঠামোর দায়িত্বে যারা অধিষ্ঠিত, তারা মব ভায়োলেন্সের পেছনের শক্তিকে তাদের ক্ষমতার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে, চোখের সামনে যেগুলো ঘটেছে সেগুলো প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে।”

রাষ্ট্রের কেন্দ্রে মব

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর গত ১৫ মাস ‘মব’ এমন এক আতঙ্কের নাম, সাংবাদিকদের পাশাপাশি এতে আক্রান্ত হয়েছে বিচার বিভাগ থেকে নির্বাহী বিভাগও।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতার সুযোগে ‘মব’ তাণ্ডব রীতিমতো ভীতিকর ‘সন্ত্রাসে’ পরিণত হয়েছে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান সোমবার ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বলেন, “রাষ্ট্রের সর্বত্র মব ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র কাঠামোর কেন্দ্রস্থলে মবতন্ত্র শুরু হয়েছে। সচিবালয়ের অভ্যন্তরে মবোক্রেসি হয়েছে এবং সেটা দিয়ে শুরু দখলবাজি, দলবাজি। 

“রাষ্ট্র কাঠামোর দায়িত্বে যারা অধিষ্ঠিত, তারা মব ভায়োলেন্সের পেছনের শক্তিকে তাদের ক্ষমতার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে, চোখের সামনে যেগুলো ঘটেছে সেগুলো প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে।” 

তাহলে কি মেরি শেলির সেই ‘ফ্রাংকেস্টাইন’ চরিত্রের কথা আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে? যেখানে- মানুষের তৈরি দানবই শেষ পর্যন্ত মানুষের জন্য ভয়ংকর হয়ে ওঠে। 

‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বাংলাদেশ কোনদিকে? 

পত্রিকার মালিক ও সম্পাদকদের শীর্ষ দুটি সংগঠন হলো সম্পাদক পরিষদ ও নোয়াব। সোমবার তারা আয়োজন করে ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবাদ সভার আয়োজন করে। সেখানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর উদ্বেগের কথা তুলে ধরেছেন। 

“আজকে যে বাংলাদেশ দেখছি, এ বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি কোনোদিন দেখিনি। ডেইলি স্টার নয়, প্রথম আলো নয়, আজকে গণতন্ত্রের উপর আঘাত এসেছে,” সোমবার  বলেন তিনি।

“শুধু সচেতন হলে হবে না, রুখে দাঁড়াতে হবে- এখন রুখে দাঁড়ানোর সময় এসে গেছে। সর্বক্ষেত্রে সর্বশক্তি নিয়ে আপনারা যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসেন, তারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হন। এই অপশক্তিকে রুখে দিতে হবে।” 

ডেভিড বার্গম্যান বলেন, এ দুটি পত্রিকা এবং তুলনামূলক কম প্রভাবশালী আরও কয়েকটি গণমাধ্যমকে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে টিকে থাকা ও স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তারাই এখন আবার, আরেকটি সংগ্রামের একেবারে সামনের কাতারে।

“চাক বা না চাক, দেশের ভেতরে চলমান আদর্শিক লড়াইয়ের সম্মুখভাগে অবস্থান করছে তারা। লড়াইটি মূলত এই প্রশ্নকে ঘিরে – বাংলাদেশ এখন কোথায় এবং ভবিষ্যতে কোন দিকে যাবে?”

দেশের শীর্ষ দুটি গণমাধ্যমে হামলার কারণ খুঁজেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। নেত্র নিউজ, আলজাজিরা ও দ্য ইকনোমিস্টসহ কয়েকটি গণমাধ্যমে বেশকিছু সাড়া জাগানো প্রতিবেদন করেছেন এই সাংবাদিক।

ডেভিড বার্গম্যান বলেন, “প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর হামলা গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কথা বলার সক্ষমতার ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলবে - তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এতে যে কিছুটা হলেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।”

সরকারের পক্ষ থেকে একটি স্বাধীন গণমাধ্যমকে সমর্থন এবং প্রয়োজনে ধারাবাহিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি।

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার অফিসে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা নিন্দা ও প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান বিবৃতি দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে সতর্ক করে বলেছে, “মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আইনশৃঙ্খলার ক্রমাগত ভাঙন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, নাগরিক পরিসর এবং বিশ্বাসযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাবনাকে বিপন্ন করে তুলছে।”

ঘটনার তাৎক্ষণিক, পূর্ণাঙ্গ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল।

ঘটনার পর মাহফুজ আনাম ও মতিউর রহমানকে ফোন করে ‘পূর্ণ নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগিতার আশ্বাস দেন’ কথা বলেন প্রধান উপদষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

যে আগুনে পুড়েছে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার,  এই আগুন কি থামবে প্রধান উপদেষ্টার আশ্বাসে?