থাইল্যান্ড-কম্বোডিয়া সংঘাত থামবে কবে

থাইল্যান্ডের সীমান্ত এলাকার বাসিন্দা রাংসান আংদা। অন্যান্য প্রতিবেশীদের মতো ব্যাগ গুছিয়ে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। কারণ সীমান্ত এলাকায় সংঘাতে জড়িয়ে গেছে প্রতিবেশী দুই দেশ থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায়। ইতোমধ্যে কম্বোডিয়া সীমান্তবর্তী দুই প্রদেশে জারি করা হয়েছে কারফিউ।

“সারাক্ষণই দুই দেশ হামলা চালাচ্ছে,” বলেন রাংসান। রবিবার তার গ্রামজুড়ে মাইকের মাধ্যমে সবাইকে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়। রাংসান জানান, গত কয়েক মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো তার এমন বাড়ি ছাড়তে হচ্ছে। এই ছেড়ে যাওয়ার পথও সহজ নয়। দীর্ঘ গাড়ির সারি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় তাদের। এভাবেই কেউ মন্দিরে, স্কুলে কিংবা সরকারি ভবনে আশ্রয় নিচ্ছেন। কেউ ছাড়ছেন গ্রাম।

গত রবিবার সংঘাত শুরুর পর থেকে সীমান্তের দুই পাশ থেকে এমন ৫ লাখ মানুষকে বাড়ি ছাড়তে হয়েছে। কেউই জানে না কবে যুদ্ধ থামবে, আবার তারা বাড়ি ফিরে আসতে পারবে কি না সেই প্রশ্নের উত্তরও অজানা।

এই নিয়ে তৃতীয়বার চলতি বছর সংঘাতে জড়ালো প্রতিবেশী দুই দেশ। সীমান্ত। গত এক সপ্তাহের সংঘাতে দুই পক্ষের অন্তত ২৭ জন নিহত হয়েছেন, ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে উভয় পাশের লাখো মানুষ। ২০২৫ সালের জুনে ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় একটি শান্তি চুক্তি হলেও ছয় মাসের মধ্যেই তা ভেস্তে গিয়েছে।

ইসরায়েল-গাজা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যখন সারাবিশ্বের মনোযোগ তখনই আবার আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড সংঘাত। তবে এই সংঘাত নতুন নয়, বছরের পর বছর ধরে প্রতিবেশী এই দুই দেশের মধ্যে বৈরী সম্পর্ক বিরাজ করছে, প্রায়ই যা সহিংসতায় রূপ নেয়।

বিরোধের কারণ কী

থাইল্যান্ড মূলত কম্বোডিয়ার সাথে তাদের সীমান্ত জুড়ে থাকা শত বছর পুরোনো মন্দিরগুলোর মালিকানা দাবি করছে, বিশেষত প্রিয়াহ ভিহার মন্দির এবং আশেপাশের অঞ্চলগুলো নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধ চলছে, যা চলছে সেই ১৯৫০-এর দশক থেকেই। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে) ১৯৬২ সালে মন্দিরটি কম্বোডিয়ার বলে রায় দিলেও, থাইল্যান্ড আশপাশের জমির মালিকানা দাবি করে আসছে, যার ফলে প্রায়ই সীমান্ত সংঘাত বাঁধে।

পাশাপাশি এই দুই দেশের ৮১৭ কিলোমিটারেরও বেশি সীমান্ত। ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের মধ্যে সংঘাত চলে আসছে। ১৯০৭ সালে ফ্রান্স দুই দেশের সীমান্ত নির্ধারণ করে যে মানচিত্র এঁকেছিল, সেখান থেকেই আসলে বিরোধের শুরু। তবে ২০০৮ সালে দুই দেশের এই বিরোধ আনুষ্ঠানিকভাবে তীব্র আকার ধারণ করে। সে সময় বিতর্কিত অঞ্চলে থাকা ওই মন্দিরকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থাইল্যান্ডে জাতীয়তাবাদী জনগণ বিক্ষোভ শুরু করে।

এক হাজার সাতশ ফিট উঁচুতে তৈরি এই মন্দিরটি ১১ থেকে ১২ শতকে তৈরি করেছিলে খেমার সাম্রাজ্যের অধিপতিরা। কম্বোডিয়ার নাগরিকদের কাছে এর সাংস্কৃতিক গুরুত্ব অনেক। কিন্তু এই মন্দির যে ভূমির ওপর তৈরি, তা নিয়েই চলছে বিবাদ। ২০০৮ সালে যখন এই মন্দিরকে ইউনেস্কো বিশ্ব সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ঘোষণা দেয়, তখন কম্বোডিয়ার হাজার হাজার মানুষ তা উদযাপনে রাস্তায় নেমে আছে। আর প্রতিবাদে নেমেছিল থাইল্যান্ড।

ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনামলে আঁকা মানচিত্র অনুযায়ী মন্দিরটি কম্বোডিয়ার অংশে পড়ে যা থাইল্যান্ড মেনে নিতে চায়নি। সবশেষ ১৯৬২ সালে আইসিজে রায় দেয় এই মন্দিরের মালিকানা কম্বোডিয়ারই থাকবে। ১৯০৭ সালে তৈরি করা মানচিত্র অনুযায়ী এটি স্পষ্টতই তাদের জমিতে অবস্থিত। তারপরও একাধিকবার থাইল্যান্ড এই জমির মালিকানা দাবি করে আসছে।  

নম পেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সে শিক্ষার্থী ও নারী অধিকারকর্মী সারভিনা কং বলেন, “থাইল্যান্ডের এমন দাবি অযৌক্তিক”। তিনি মনে করেন, কম্বোডিয়া সংঘাতে জড়াতে চায় না। “তারা এখন পল পটের গণহত্যার ক্ষত কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। ৮০ ও ৯০ এর দশকে যে গেরিলা যুদ্ধ হয়েছে সেখানে প্রাণ গেছে ২৫ লাখেরও বেশি মানুষের। পুরো দেশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল, তাই কোনো দেশ যদি শান্তিতে থাকতে চায় তবে তা কম্বোডিয়া।” তিনি বলেন।

তবে ২০২৫ সালে এসে দুই দেশের উত্তেজনা চরম রূপ ধারণ করেছে, একাধিকবার সংঘাতেও গড়িয়েছে। গত মে মাসে থাইল্যান্ডের হামলায় একজন কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হওয়ার পর দুই পক্ষ থেকেই কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। প্রথমে সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করে থাইল্যান্ড। কম্বোডিয়ায় থাই সিনেমা দেখানো বন্ধ হয়, থাই ফল, সবজি ও জ্বালানি আমদানিও বন্ধ করে দেয় তারা।

এরপর জুলাই মাসে ভয়াবহ আকার ধারণ করে দুই প্রতিবেশী দেশের সম্পর্ক। পাঁচ দিনের পূর্ণ যুদ্ধে নামে দুই প্রতিবেশী দেশ। অন্তত ৪৮ জন সেই যুদ্ধ নিহত হন। বাস্তুচ্যুত হয় তিন লাখেরও বেশি মানুষ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় থামে যুদ্ধ। অক্টোবরে মালয়েশিয়ায় এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে দুই দেশ।  

নতুন করে সংঘাত

কাগজে-কলমে চুক্তি থাকলেও, উত্তেজনা কমছিল না। নভেম্বরে সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে এক থাই সেনা আহত হওয়ার পর দেশটি শান্তিচুক্তি বাতিল করে। এর ঠিক দুইদিন পরই আবার সংঘাত শুরু হয়, কম্বোডিয়ার একজন সেনা নিহত হন, আহত হন আরও তিন জন।

এরপর একাধিকবার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে থাইল্যান্ড। সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সংঘাতময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এখন পর্যন্ত কম্বোডিয়ার সাতজন বেসামরিক নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও ২০ জন। অন্যদিকে থাইল্যান্ডের তিনজন সেনাও মারা গেছে। দুই পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছে।

সর্বশেষ উত্তেজনা শুরু হয় মে মাসে, যখন সংঘর্ষে এক কম্বোডিয়ান সেনা নিহত হয়। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্ক এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে নেমে যায়।
জুলাইয়ের সংঘর্ষের আগে উভয় দেশই একে অপরের ওপর সীমান্তে নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। কম্বোডিয়া থাইল্যান্ড থেকে ফল ও সবজি আমদানি বন্ধ করে দেয়, পাশাপাশি বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সেবা নেওয়াও বন্ধ করে।

গত সপ্তাহে থাই সেনাবাহিনী দাবি করেন, কম্বোডিয়া রকেট ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। তাদের বোমা দুটি সাধারণ নাগরিকের বাড়িতেও আঘাত হেনেছে। অন্যদিকে কম্বোডিয়ার অভিযোগ, থাইল্যান্ড বেসামরিক এলাকায় আগ্রাসন চালিয়েছে। বেসামরিক অবকাঠামো, মন্দির ও সাংস্কৃতিক  সম্পদ ধ্বংস করেছে।

ট্রাম্প কি আবার যুদ্ধ থামাতে পারবেন?

গত অক্টোবরে ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ থেমেছিল থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার। মালয়েশিয়ায় শান্তি চুক্তি অনুষ্ঠানের সময় ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন, যদি কোনো দেশ চুক্তি মানতে অস্বীকার করে, তাহলে তিনি তাদের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি করবেন না।
এবারও যুদ্ধ থামানোর ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী ট্রাম্প। শনিবার তিনি বলেন, “আমার মনে হয় আমি তাদের যুদ্ধ থামাতে পারবো। আমি না পারলে আর কে পারবে?”
তবে সীমান্তে থাকা বাসিন্দারা এতটা আশাবাদী নন। সোমবার নিজ বাড়ি ছাড়তে ছাড়তে পাতশ্রী কোটমাকতি নামে এক থাই নারী বলেন, “ট্রাম্পের সেই ক্ষমতা থাকলে এই যুদ্ধই হতো না।”

তিনি বলেন, চার মাস আগেই দুই পক্ষের অনবরত বোমাবর্ষণে বারবার কেঁপে উঠেছে তার বাড়ি। তিনি এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন বলে জানান।
নতুন করে শুরু হওয়া এই সংঘাত কয়েক মাস ধরে চলতে পারে বলে আশঙ্কা তার। তিনি বলেন, “আমি হয়তো শেষ পর্যন্ত বেঁচেও থাকবো না।” তিনিসহ অনেক প্রতিবেশীই দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তাদের নির্ধারিত কোনে আয় নেই। তিনি বলেন, “যারা এখানে থাকছে তাদের কাছে টাকা নেই, তাদেরকে ঋণ করতে হচ্ছে এবং সেটা সুদসহ ফেরত দিতে হচ্ছে।”

তিনি চান, খুব দ্রুত যেন এই পরিস্থিতির অবসান ঘটে।

থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার ওপর শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়ে যুদ্ধ থামিয়েছিলেন ট্রাম্প। এবারও ট্রাম্প যুদ্ধ থামাতে পারবে কি না তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্লেষকরা। ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং ফেলো ড. নাপোন জাত্রুস্রিপিতাক বলেন, ট্রাম্প অন্য প্রভাব খাটিয়ে যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করেছেন। তার আগে থাইল্যান্ড সব রকম তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা প্রত্যাখ্যান করেছে।

নাপোন বলেন, এখনো ট্রাম্পের সেই প্রভাব থাকবে কি না তা স্পষ্ট নয়। ২০২৬ সালে থাইল্যান্ডে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই অবস্থায় নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী আনুতিন চার্নবিরাকুল জাতীয়তাবাদকে পুঁজি করতে পারেন। তিনি বলতে পারেন, থাইল্যান্ডের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছেন।

এই বিশ্লেষক আরও বলেন, এই পদক্ষেপ নিয়ে থাইদের মধ্যে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়াতে পারেন প্রধানমন্ত্রী। ট্রাম্পের সেই চাপে তিনি নত নাও হতে পারেন। কারণ এখন তার অবস্থান শক্ত রাখা রাজনৈতিকভাবে জরুরি।

অগাস্টে করা এক জরিপে দেখা যায়, অর্ধেকের বেশি মানুষ বিশ্বাস করেন কম্বোডিয়ার সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক করা উচিত নয় থাইল্যান্ডের। এ ছাড়া এই সংঘাতে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপকেও সহজভাবে অনেকে নেয়নি বলে জরিপে আভাস মিলেছে।

প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারীই বলেছেন, পরাশক্তি দেশগুলো নিজেদের স্বার্থে এখানে যুক্ত হয়েছে, এখানে থাইল্যান্ডের কোনো লাভ নেই। ১০ শতাংশেরও কম মানুষ মনে করেন ট্রাম্প আসলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় যুক্ত হয়েছেন।

থাইল্যান্ডের সেনাপ্রধান চায়াপ্রুক দুয়াংপ্রাপাত হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তারা কম্বোডিয়ার সেনা সক্ষমতাকে গুঁড়িয়ে দিতে চায় যেন দীর্ঘমেয়াদে তারা আর হুমকি না হয়ে উঠতে পারে।  

সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে অস্থায়ীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া রিন্দ মেতমাতকে দ্য গার্ডিয়ান জিজ্ঞাসা করেছিল ট্রাম্প কি আবারও শান্তিচুক্তি করতে পারবে। জবাবে তিনি বলেন, “এটা ট্রাম্পের দৃষ্টিকোণ। সবারই নিজের মত আছে। আমি আসলে কারও ক্ষতি চাই না। যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেনাদের জন্য, তাদের পরিবারের জন্য, সন্তানদের জন্য আমার খারাপ লাগে। কম্বোডিয়ার সেনাদের জন্যও আমার খারাপ লাগে। আমার মনে হয় না তারাও যুদ্ধ চায়।”

রিন্দ মেতমাত বলেন, যতজনই এখানে যুক্ত হোক, এই সংঘাত সহজে থামছে না। তিনি বলেন, “কথা বলে সবকিছুর সমাধান হয় না।”

(দ্য গাডির্য়ান, বিবিসি, ওয়ার্ল্ড পালস, রয়টার্সের প্রকাশিত তথ্য অবলম্বনে)