ছেলেটার বয়স ২৭। ময়মনসিংহের তারাকান্দায় বাড়ি। ভালুকায় মেসে থাকতেন। চাকরি করতেন একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে।
অন্যদিনের মতো কাজে গিয়েছিলেন বটে। কিন্তু ফেরেননি। ফেরেননি বললে ভুল হবে। বলা ভালো জীবিত ফেরেননি।
হাজারখানেক মানুষ তাদেরই মত রক্ত-মাংসের আরেকটা মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তার লাশটাও আবার আগুনে পোড়ানো হয়েছে কয়েক মিনিট ধরে। তাও গাছে ঝুলিয়ে।
ছেলেটার নাম দীপু চন্দ্র দাস। সনাতন ধর্মের অনুসারী। অভিযোগ উঠেছিল, তিনি ধর্ম নিয়ে, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-কে নিয়ে কটূক্তি করেছেন। কিন্তু কোথায় কীভাবে কী কটূক্তি করেছেন সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোন ধারণা পুলিশের সাথে কথা বলেও পাওয়া যায়নি।।
১৮ই ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাত নয়টার কিছু পরে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার ডুবালিয়া পাড়ায় ঘটনাটি ঘটেছে।
কথা বলেছিলাম ভালুকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. জাহিদুল ইসলামের সাথে। তিনি বলছিলেন, “আমরা থানায় থাকা অবস্থায় ওখানের ফ্যাক্টরির লোকজন জানাল যে ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করার অভিযোগে উত্তেজিত জনতা একজনকে মারার জন্য চেষ্টা করছে। আমরা খবর পাওয়ার সাথে সাথে রওনা দিয়েছি।”
থানা থেকে ঘটনাস্থল মিনিট বিশেকের পথ। কিন্তু দশ মিনিটের মাথায় ফের ফোন পেলেন ওসি। রিসিভ করতেই শুনলেন, “রাখতে পারলাম না, ৭০-৮০ জন লোক ওকে বের করে নিয়ে গেছে।”
টহল পার্টিও ওসিকে ফোন করে নিশ্চিত করল তার মৃত্যুর ঘটনা। ওসিকে ফোনে টহল পার্টি জানাল, “স্যার ওকেতো মেরে ফেলছে। টেনে হিঁচড়ে গেটের সামনে আনছে, তারপর মেরে ফেলছে।”
থানার ওসি বলছিলেন, “তারপর মিছিল করতে করতে মেইন রোডে গিয়ে রাস্তা অবরোধ করেছে। অনেক মানুষ, হাজারেরও বেশি মানুষ। তারপর আইল্যান্ডের মধ্যে যে ছোট ছোট গাছ থাকে, ওর মধ্যে (মরদেহ) বাঁধছে। তারপর আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আগুন দেওয়ার কারণে যে রশিতে বাঁধছে সেই রশি পুড়ে যাওয়ার কারণে পড়ে যায়। দুই তিন মিনিটের মতো আগুন জ্বলেছে।”
এরপর সেনাবাহিনী যায় ঘটনাস্থলে। হাজির হন উপজেলা নির্বাহী অফিসার। শিল্প পুলিশ ছিল আগে থেকেই। মাইকে অনুরোধ করে বুঝিয়ে ’উত্তেজিত জনতা’কে শান্ত করতে লেগেছে দেড় ঘণ্টা।
তারপর দীপু চন্দ্র দাসের মরদেহ উদ্ধার করে মর্গে পাঠায় পুলিশ। কিন্তু কারা ঘটালো এমন ঘটনা? কেনইবা ঘটালো? কিংবা তার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ সেটা দেখেছে কে? কে অভিযোগটা করলেন?
ভালুকা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলছিলেন, “সে ফেইসবুকে স্ট্যাটাস দিলে থাকতো, কিন্তু মুখের কথা যে যেভাবে পারছে বলেছে। কিংবা কেউ যে সামনে থেকে দেখেছে বা শুনেছে এমনও কাউকে আমরা পাইনি। ফেইসবুক আছে কি-না তাও পরিষ্কার না।”
পিটিয়ে মেরে লাশে আগুন দেওয়ার মতো ‘উত্তেজিত জনতা’ কারা? কাউকে অবশ্য তাৎক্ষণিকভাবে চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ। ওসি বলছিলেন, “আমরা যা দেখসি, যে যেভাবে পারছে আসতেছে। ওইরকম থাকতে পারে। একটা বুনো উল্লাস তাদের ভেতরে।”
ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন ভালুকার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. ফিরোজ হোসেন। সে সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “যেটা আমরা জানতে পারলাম, একজন ব্যক্তি, যে মহানবীকে নিয়ে কটূক্তি করেছিল। সেটাতে জনসাধারণ ক্ষুব্ধ হয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। একটা মবের ক্রিয়েট হয়।”
দীপুর মরদেহ নিয়ে সেই ‘মব’ রাস্তা অবরোধ করে। ইউএনও বলছিলেন, “মবের কারণে ট্রাফিক কন্ট্রোল করা টাফ হচ্ছিলো। পুলিশ, সেনাবাহিনী সবাই ছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। পরে আমরা গিয়ে তার লাশটা নিয়ে আসি।”
জড়িতরা কারা? এমন প্রশ্নে ইউএনও বলেন, “কারা করল সেটা তদন্ত করে দেখতে হবে। সিচুয়েশন বাজে ছিল, তাই ওইগুলো প্রসেসে আমরা যাইনি ওই সময়ে। পরবর্তীতে তদন্ত করে, যেহেতু একটা ঘটনা ঘটেছে, এটাতো আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে কিছু করার সুযোগ নাই।”
নিহতের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ, তা যাচাই বাছাই করার কথা জানিয়েছেন ইউএনও। বলছিলেন, “একজন একটা দাবি তুললো, সেই দাবির পক্ষে কোনও প্রমাণ আছে কি-না বা সে দাবিটা কতটা যৌক্তিক, বা অন্য কোনও বিষয় আছে কি-না, এটা তদন্ত করলে পাওয়া যাবে। পরিস্থিতি একটু থমথমে, তাই একটু স্লো আগাচ্ছি।”
এই ঘটনায় পরিবারের লোকজন না পাওয়ায় প্রথমদিকে মামলা হয়নি। শুক্রবার দুপুর দুইটার দিকে স্বজনরা থানায় আসার পর মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে থানার ডিউটি অফিসার।
সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতিতেও এসেছে দীপু হত্যার ইস্যু। সেখানে বলা হয়েছে, “ময়মনসিংহে এক হিন্দু ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় আমরা গভীরভাবে নিন্দা জানাই। নতুন বাংলাদেশে এ ধরনের সহিংসতার কোনো স্থান নেই। এই নৃশংস অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।”