চূড়ান্ত হলো ২০২৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের গ্রুপ। জানা গেলো কার প্রতিপক্ষ কে, কারা আছে গ্রুপ অব ডেথ-এ। কার হাতে উঠতে পারে এবারের ট্রফি, কোন দল থাকবেন ফেভারিট, সেই হিসাবও কষতে শুরু করেছেন ভক্ত ও বিশ্লেষকরা।
‘দ্য গ্রেইটেস্ট শো অন আর্থ’ নামে খ্যাত ফুটবল বিশ্বকাপের ২০২৬ সালের আসর বসছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে। ৫ই ডিসেম্বর শুক্রবার ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয়েছে গ্রুপের ড্র। বর্তমান চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা আছে জে গ্রুপে। তাদের সঙ্গে আছে আলজেরিয়া, অস্ট্রিয়া ও জর্ডান। গ্রুপ সি-তে ফেভারিট ব্রাজিলের সঙ্গে আছে মরক্কো, হাইতি ও স্কটল্যান্ড।
গ্রুপ এল-কে বলা হচ্ছে `গ্রুপ অব ডেথ’। এই গ্রুপে আছে ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, ঘানা ও পানামা। জার্মানির সঙ্গে আছে, কিউরুসাও, আইভরি কোস্ট ও ইকুয়েডর এবং ফ্রান্সের গ্রুপে আছে সেনেগাল ও নরওয়ে।
বর্তমান রানারআপ ফ্রান্স আছে আই গ্রুপে। এখন পর্যন্ত তাদের সঙ্গে নিশ্চিত সেনেগাল ও নরওয়ে। আরেকটি প্রতিপক্ষ এখনো নিশ্চিত হয়নি। প্লেঅফ থেকে যুক্ত হবে আরও কয়েকটি দেশ।
ফুটবল বোদ্ধারা বলছেন, ২০২৬ বিশ্বকাপে সবচেয়ে সহজ গ্রুপে পড়েছে জার্মানি, স্পেন ও বেলজিয়াম। ফিফা র্যাংকিং আমলে নিয়ে তারা এই অনুমান করছেন। তারা বলছেন, সে হিসেবে সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ পেয়েছে নেদারল্যান্ডস ও ফ্রান্স।
ফর্মে আছে কারা
ইংল্যান্ড
পারফেক্ট রেকর্ড নিয়ে বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করেছে ইংল্যান্ড। পুরো বাছাইপর্বে সবগুলো ম্যাচ জিতেছে তারা, হজম করেনি একটি গোলও। গত দু’টি ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে ছিল রানারআপ। বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালেও উঠেছিল তারা। বর্তমান কোচ থমাস টাচেলের তত্ত্বাবধানে তারা দারুণ কিছু করতে পারে বলে মনে করছেন ভক্তরা।
জুয়ারিরাও তাদের ওপর ভরসা রাখছেন। স্পেনের পর ইংল্যান্ডই তাদের প্রথম পছন্দ।
স্পেন
ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন স্পেনও বাছাইপর্বে ইংল্যান্ডের মতো পারফেক্ট রেকর্ডের খুব কাছেই ছিল। কিন্তু শেষ ম্যাচে তুরস্কের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করায় তা হয়নি। তারপরও হট ফেভারিট স্পেন। ২০২৪ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়ন, তাদের সঙ্গে আছে হালের সেনসেশন লামিন ইয়ামাল। যাকে বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় বিবেচনা করা হচ্ছে।
সর্বশেষ জুনে নেশন্স লিগের ফাইনালে পর্তুগালের সঙ্গে পেনাল্টি শুটআউটে হার মানে স্পেন। এর আগে ২০২৩ সালের মার্চ থেকে তাদের কোনও ম্যাচ হারের রেকর্ড নেই।
ফ্রান্স
২০২২ বিশ্বকাপের রানার আপ ফ্রান্সও রয়েছে হট ফেভারিটের তালিকায়। তৃতীয়বারের মতো তাদের হাতে উঠতে পারে ফুটবল বিশ্বকাপ ট্রফি, এমন আশায় বুক বাঁধছে ভক্তরা।
ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে বাছাইপর্বে দিদিয়ের দেশাম্পের দল হারেনি কোনও ম্যাচই।
অপটার সুপার কম্পিউটারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, স্পেনের বিশ্বকাপ জেতার সম্ভাবনা ১৭ শতাংশ, ফ্রান্সের ১৪ দশমিক ১ শতাংশ ও ইংল্যান্ডের ১১ দশমিক ৮ শতাংশ।
জার্মানি
ইউরোপের পাওয়ার হাউস জার্মানিও আছে ফেভারিটের তালিকায়। চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের ওপর বাজি ধরছেন অনেকে। বাছাইপর্বে তাদের পারফরমেন্সও আশা জাগানিয়া।
ব্রাজিল
সর্বোচ্চ বিশ্বকাপ জেতা ব্রাজিল এবার বাছাইপর্বে ছিল অনেকটাই নিস্প্রভ। গত বছরগুলোতেও সাম্বা ফুটবলের আলো ছড়াতে পারেনি নেইমারের দল। আঞ্চলিক বাছাইপর্বে তারা ৫ম স্থানে থেকে শেষ করেছে। ১৮ ম্যাচের ছয়টিতেই হেরেছে। তবে বাজিকরদের পছন্দের তালিকার চার নম্বরে রয়েছে তারা।
আর্জেন্টিনা
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার ফর্ম দুর্দান্ত। লাতিন আমেরিকার বাছাইপর্ব শীর্ষে থেকে শেষ করেছে তারা। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ইকুয়েডরের সঙ্গে তাদের পয়েন্ট ব্যবধান ৯।
এখন পর্যন্ত ফুটবল ইতিহাসে ব্রাজিলই একমাত্র দল যারা পরপর দুই বিশ্বকাপ জিতেছে, ১৯৫৮ ও ১৯৬২ সালে। তবে লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনার সামনে এবার সেই সুযোগ এসেছে। আবারও ফুটবল জাদুকর বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরবেন, এমন স্বপ্ন দেখেন বিশ্বের কোটি কোটি আর্জেন্টাইন ভক্ত।
অন্যান্য অঞ্চলের শীর্ষ বাছাই
এশিয়া থেকে বাছাইপর্বে দুর্দান্ত পারফরমেন্স ছিল জাপানের। মাত্র একটি ম্যাচ হেরেছে তারা। এ ছাড়া কাতার ও মরক্কোও আফ্রিকান অঞ্চল থেকে কোনও ম্যাচ না হেরে কোয়ালিফাই করেছে। বড় দলগুলোর জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে তারাও। মিসর, সেনেগাল, আইভরি কোস্ট ও তিউনিশিয়ার ফর্মও দারুণ।
এই বিশ্বকাপের পর অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। তার দল রয়েছে গ্রুপ কে-তে। রোনালদো নিজেই পর্তুগালের জয়ে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠবেন নিশ্চিত।২০২০ ইউরো চ্যাম্পিয়ন ও চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ইতালিকে খেলতে হচ্ছে প্লেঅফ।
আবহাওয়া থাকবে যেমন
এবারের বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোতে। ওই সময় গ্রীষ্মকাল থাকবে। ফলে ম্যাচের সময় তীব্র গরম পড়ার সম্ভাবনাই বেশি।
এর আগে গ্রীষ্মে ক্লাব বিশ্বকাপ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল অনেক। চেলসি মিডফিল্ডার এনজো ফার্নান্দেজ জানিয়েছিলেন, খেলাল সময় তীব্র গরমে মাথা ঘুরছিল তার।
কুইনস ইউনিভার্সিটির বেলফাস্ট এর গবেষণায় দেখা যায়, ২০২৬ সালের বিশ্বকাপের ব্যবহৃত ১৪ থেকে ১৬টি স্টেডিয়ামে তাপমাত্রা বিপজ্জনক মাত্রায় থাকতে পারে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনও কোনও দেশ হয়তো এই গরমে মানিয়ে নিতে পারবে। তবে ইউরোপীয় দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে এই কন্ডিশন। ইংল্যান্ড অনুরোধ করেছে গরম এড়াতে দেরি করে খেলা শুরুর জন্য।
এই কন্ডিশনে লাতিন আমেরিকার ও আফ্রিকার দেশ লাভবান হতে পারে। আর আয়োজক দেশ হিসেবে সুবিধা পেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোও।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
বিবিসি রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাতকারে সাবেক ইংলিশ স্ট্রাইকার ডিও ডাবলিন বলেন, “আমি সবসময় ক্রোয়েশিয়াকে নিয়ে চিন্তিত। তাদের অভিজ্ঞতা ও সামর্থ্য দুটিই আছে।”
ঘানাও দারুণ পারফর্ম করতে পারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা অত্যন্ত শক্তিশালী আফ্রিকান দল। তাদের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন শব্দ ব্যবহার করাই ঠিক হবে।”
ইউরোপিয়ান ফুটবল সাংবাদিক জুলিয়েন লরেন্স বলেছেন, “আমি জানি স্পেন নেশন্স লিগের ফাইনালে পর্তুগালের কাছে হেরেছে। তবে লুই দো লা ফুয়েন্তের অধীনে তারা দারুণ ফুটবল খেলছে।”
তিনি বলেন, “ইউরোতে দারুণ পারফর্ম করেছে তারা। যদিও ইংল্যান্ড তাদের সাথে ভালো লড়াই করেছে। তবে তারাই যোগ্য বিজয়ী।”
ফরাসি এই সাংবাদিক আরও বলেন, “আমরা (ফ্রান্স) এমবাপের ওপর ভরসা করছি। আমার মনে হয় না পুরো দলেই খুব বেশি দুর্বলতা আছে।”
জার্মানির ব্যাপারে তিনি বলেন, “আপনি জানেন না এই টুর্নামেন্টে কেমন জার্মানি দেখতে যাচ্ছেন আপনি। তারা দারুণ কিছু করার সামর্থ্য রাখে এবং জামাল মুসিয়ালা জানুয়ারিতে দলের সঙ্গে যোগ দেবে। আর যদি ফ্লোরিয়ান উইরজ সেরা ফর্মে থাকে, মুসিয়ালা সেরা ফর্মে থাকে এবং নিক ওলটেমেডে ও কাই হাভেরতজেকে সঙ্গে নিয়ে দারুণ কিছু করতে পারবে তারা। বিশেষ করে আক্রমণে।”
তবে জার্মানির রক্ষণ নিয়ে তিনি নিশ্চিত নন বলে মন্তব্য করেন জুলিয়েন লরেন্স।
দক্ষিণ আমেরিকার ফুটবল সাংবাদিক টিম ভিকেরি বলেছেন, ‘ব্রাজিল তাদের ড্র নিয়ে খুশি। নিউ জার্সি, বস্টন, ফিলাডেলফিয়া, মায়ামি, আটলান্টায় একটা-যেটাতে এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থা আছে, আর কার্লো আনচেলত্তি মনে করছেন তাদের খেলাগুলো সন্ধ্যার পর হবে। তাই তারা বিষয়গুলো নিয়ে সন্তুষ্ট।”
তিনি আরও বলেন, ‘সবকিছুই খুব দ্রুত হচ্ছে কারণ আনচেলত্তি শেষ মুহূর্তে দায়িত্ব নিয়েছে। তারপরও দল অনেক উন্নতি করেছে। তিনি চারজনকে সামনে খেলাতে চাচ্ছেন। আনচেলত্তি যদি সেই আক্রমণের প্রতিভাকে কাজে লাগাতে পারেন, যেমনটা তিনি প্রীতি ম্যাচগুলোতে করেছেন তবে কোনো দলই ব্রাজিলের বিপক্ষ স্বস্তিতে থাকবেন না।”
আর্জেন্টিনার ব্যাপারে ভিকারি বলেন, “তারা এমন কিছু করার চেষ্টা করছে যা আগে কেউ করেনি। বিশ্বকাপ নিজেরে কাছে রেখে দেওয়ার চেষ্টা করছে যা নিজেদের মহাদেশের বাইরে আগে কেউ করেনি।”
তিনি বলেন, “বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনার সময়টা দারুণ কাটছে। তারা সবকিছুই জিতে চলেছে। বিশাল ব্যবধানে তারা বাছাইপর্ব পার করেছে আর শুধুমাত্র লিওনেল মেসির ওপর তারা এখন আর একক নির্ভরশীল নয়, একসময় যা ছিল।”
কে কোন গ্রুপে
গ্রুপ এ: মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা, দক্ষিণ কোরিয়া, ইউরো প্লে অফ ডি বিজয়ী
গ্রুপ বি: কানাডা, ইউরো প্লে অফ এ বিজয়ী, কাতার, সুইজারল্যান্ড
গ্রুপ সি: ব্রাজিল, মরক্কো, হাইতি, স্কটল্যান্ড
গ্রুপ ডি: যুক্তরাষ্ট্র, প্যারাগুয়ে, অস্ট্রেলিয়া, ইউরো প্লে অফ সি বিজয়ী
গ্রুপ ই: জার্মানি, কিউরাসাও, আইভরি কোস্ট, ইকুয়েডর
গ্রুপ এফ: নেদারল্যান্ডস, জাপান, ইউরো প্লে অফ বি বিজয়ী, টিউনিশিয়া
গ্রুপ জি: বেলজিয়াম, ইজিপ্ট, ইরান, নিউ জিল্যান্ড
গ্রুপ এইচ: স্পেন, কেপ ভার্দে, সৌদি আরব, উরুগুয়ে
গ্রুপ আই: ফ্রান্স, সেনেগাল, ফিফা প্লে অফ ২ বিজয়ী, নরওয়ে
গ্রুপ জে: আর্জেন্টিনা, আলজেরিয়া, অস্ট্রিয়া, জর্ডান
গ্রুপ কে: পর্তুগাল, ফিফা প্লে অফ ১ বিজয়ী, উজবেকিস্তান, কলম্বিয়া
গ্রুপ এল: ইংল্যান্ড, ক্রোয়েশিয়া, ঘানা, পানামা
*প্লে অফ বিজয়ী- মানে হলো বাছাইপর্বের প্লে অফ থেকে আসা দল।
উয়েফা প্লে-অফ এ: ইতালি, ওয়েলস, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা অথবা উত্তর আয়ারল্যান্ড
উয়েফা প্লে-অফ বি: ইউক্রেন, পোল্যান্ড, আলবেনিয়া অথবা সুইডেন
উয়েফা প্লে-অফ সি: তুরস্ক, স্লোভাকিয়া, কসোভো অথবা রোমানিয়া
উয়েফা প্লে-অফ ডি: ডেনমার্ক, চেক প্রজাতন্ত্র, আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্র অথবা উত্তর মেসিডোনিয়া
ফিফা প্লে-অফ ১: ডিআর কঙ্গো, জ্যামাইকা অথবা নিউ ক্যালেডোনিয়া
ফিফা প্লে-অফ ২: ইরাক, বলিভিয়া অথবা সুরিনাম