“আমরা একটা হত্যার যুগে প্রবেশ করেছি” - মাহফুজ আনাম, ডেইলি স্টার
“মবতন্ত্র প্যান্ডোরার বক্সের মত বিকশিত হয়েছে” - ড. ইফতেখারুজ্জামান, টিআই’বি।
“সরকার সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে” - আইরিন খান, জাতিসংঘ প্রতিনিধি।
“সরকারের ভেতরের একটা অংশের এখানে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে” - নাহিদ ইসলাম, এনসিপি।
“এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকার তার নৈতিক বৈধতা অনেকক্ষেত্রেই হ্রাস করে ফেলেছে” - ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সিপিডি।
“এই যে সমস্ত আক্রমণ সেগুলোর বিচার যদি করতে না পারেন, আপনাদের ব্যর্থতাই আমাদের রায় হবে” - জোনায়েদ সাকি, গণসংহতি আন্দোলন।
“শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দিয়ে পরবর্তী সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন” - আনোয়ারুল আলম চৌধুরী পারভেজ, পোশাক রপ্তানিকারক।
“আজকে যে বাংলাদেশ দেখছি এ বাংলাদেশের স্বপ্ন আমি কোনোদিন দেখিনি” - মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বিএনপি।
“যেখানে সবার একসাথে সমাধানের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা, সেখানে একটা সাংস্কৃতিক যুদ্ধ বাধিয়ে দেয়া হয়েছে” - আসিফ সালেহ, ব্র্যাক।
বক্তব্যগুলো পড়ুন। প্রতিটি বক্তব্যের পাশে কার নাম - তাদের পরিচয় কী সেটা পড়ুন। এরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। এদের কেউ বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন, কেউ শীর্ষ রপ্তানিকারক - বিদেশ থেকে ডলার আনেন, বড় রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, জাতিসংঘের প্রতিনিধি, সাংবাদিক নেতা, বড় গণমাধ্যমের সম্পাদক, এনজিও প্রতিনিধি এমনকি সবচেয়ে বড় এনজিওর শীর্ষ কর্তা।
এরা সবই এক হয়েছিলেন একটি প্রতিবাদ সভায়। শরীফ ওসমান হাদীর মৃত্যুকে ঘিরে তৈরি হওয়া বিক্ষোভ থেকে যে ‘মব’ হামলা হয়েছে গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে তার প্রতিবাদ।
শিরোনাম ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’। যৌথভাবে আয়োজন করে সংবাদপত্র সম্পাদকদের সংগঠন ‘সম্পাদক পরিষদ’ ও মালিকদের সংগঠন ‘নোয়াব’ (নিউজ পেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন)।
ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ঘণ্টা দুয়েকের প্রতিবাদ সভা শেষে পরে সবাই মিলে একটি মানববন্ধনে যোগ দেন।
অভিযোগের আঙুল সরকারের দিকে
প্রতিবাদসভায় বক্তাদের কথায় ছিল স্পষ্টতই সরকারের নিষ্ক্রিয়তার প্রতি অসন্তোষ। বক্তারা মনে করেন, গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোতে হামলা ছিল ‘পরিকল্পিত’ এবং এটা ঠেকাতে ‘ব্যর্থ’ হয়েছে সরকার।
এমনকি একজন বক্তা অভিযোগ করেন, এই হামলায় সরকারের একাংশ জড়িত ছিল।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “সরকারের ভেতরের একটা অংশের এখানে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। সমাজে এটার পক্ষে সম্মতি তৈরি করা হয়েছিল অনেকদিন ধরেই”।
“এটার সাথে রাজনৈতিক ব্যাকআপও আছে।”
সিপিডির ডিস্টিংগুইশড ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্য বলেন, “যদি একটি প্রতিষ্ঠানকে আমাদের দায়িত্ব নিতে হয় তাহলে বর্তমান সরকারকে নিতে হবে”।
“তাদের মনে রাখা উচিত তারা কোন নির্বাচিত সরকার না” উল্লেখ করে ড. ভট্টাচার্য্য বলেন, “একটি অনির্বাচিত সরকারের শাসন করার যোগ্যতা ক্ষমতা থাকে ততক্ষণ যখন তার নৈতিক বৈধতা থাকে।”
“এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে বর্তমান সরকার তার নৈতিক বৈধতা অনেকক্ষেত্রেই হ্রাস করে ফেলেছে,” বলেন ড. ভট্টচার্য।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্বাচিত স্পেশাল র্যাপোর্টার অব ফ্রিডম অব অপিনিয়ন অ্যান্ড এক্সপ্রেশন আইরিন খানও এই প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, “এখন যা হচ্ছে সেটা হলো - এই দেশে গত কয়েক মাস ধরে যেভাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা আক্রান্ত হয়েছে - বিশেষ করে সাংবাদিক, শিল্পী, রম্যলেখক এবং যারা সরব - তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্থা নিতে সরকারের ব্যর্থতার ফলাফল।”
বক্তারা প্রতিবাদ করছিলেন ১৮ই ডিসেম্বর রাত থেকে ১৯এ ডিসেম্বর বিকেল পর্যন্ত বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা ও মব ভায়োলেন্স নিয়ে।
সন্ত্রাসী হামলায় আহত ঢাকা ৮ আসনের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুর খবর বের হবার পর ১৮ই ডিসেম্বর রাতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সেই বিক্ষোভের মধ্যেই ‘মব’ সৃষ্টি করে ঢাকায় প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের কার্যালয় ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এই হামলার প্রেক্ষাপটে পরদিন শুক্রবার পত্রিকাদুটি প্রকাশিত হয়নি। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয় ছায়ানট ও উদীচীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও। এছাড়া ভালুকায় এক হিন্দু ব্যক্তিকে মব হামলা চালিয়ে হত্যা করার পর তার মৃতদেহ গাছে ঝুলিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয়। হামলা চালানোর চেষ্টা হয় চট্টগ্রাম ও খুলনায় ভারতীয় কূটনীতিকদের বাসভবনেও। এসব ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ গত কয়েকদিন ধরে উত্তপ্ত হয়ে আছে।
‘হত্যার যুগে প্রবেশ করেছি’
প্রতিবাদ সভায় ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম গণমাধ্যমে হামলা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা গেছে, তারা বলছে, ডেইলি স্টার এবং প্রথম আলোর যারা সাংবাদিক তাদের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদেরকে হত্যা করতে হবে”।
“ছাব্বিশ-সাতাশ জন ছাদে আটকে ছিল এবং ফায়ার ব্রিগেডকে সেখানে আসতে দেয়া হয় নাই - এটার মানে কী? তারা শুধু ভবনটিই পুড়িয়ে দিতে চায়নি, তারা ডেইলি স্টারের কর্মীদের হত্যা করতে চেয়েছিল।”
“আমরা একটা হত্যার যুগে প্রবেশ করেছি। মত প্রকাশতো অনেক দূর হয়ে গেছে, আজকে বেঁচে থাকার অধিকারের ব্যাপার এসে গেছে”, বলেন মাহফুজ আনাম।
মবতন্ত্র
বাংলাদেশে ৫ই অগাস্টের পর থেকে ‘মব ভায়োলেন্স’ নামে এক নতুন ধরনের চাপ দিয়ে দাবি আদায় এবং অপরাধের শাস্তি দেবার প্রবণতা দেখা গেছে। অনেকেই এই ধরনের গণকর্মসূচীকে ‘মবতন্ত্র’ বলে বর্ণনা করেন।
এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও এই ধরনের মব ভায়োলেন্সকে স্বীকৃতি দিতে দেখা গেছে এবং এতে অংশ নেয়া মানুষকে ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর দাবি সরকার মেনে নেয়ার পর থেকে বাংলাদেশে এই মব ভায়োলেন্সের দৌরাত্ম্য শুরু হয়েছে উল্লেখ করে ওয়ান এলেভেনের সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং শিক্ষাবিদ রাশেদা কে. চৌধুরী বলেন, “তারপর দেখলাম মবের রাজ্য হয়ে গেছে বাংলাদেশ।”
“রাষ্ট্র কাঠামোর কেন্দ্রস্থলে মবতন্ত্র শুরু হয়েছে” উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “রাষ্ট্র কাঠামোর দায়িত্বে যারা অধিষ্ঠিত তারা মব ভায়োলেন্সের পেছনের শক্তিকে তাদের ক্ষমতার অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করে তাদের চোখের সামনে যেগুলো ঘটেছে সেগুলো প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে।”
প্রথম আলো, ডেইলি স্টারসহ প্রতিষ্ঠানগুলোতে মব হামলা চালানোর আগে সেগুলোর পক্ষে সম্মতি উৎপাদনও করা হয়েছে বলে মনে করেন এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
তিনি বলেন, “এটা খুব স্পষ্ট যে কারা সেটার পক্ষে সম্মতি তৈরি করেছে, কারা সেই রাতে সেখানে গিয়েছে, লেখালেখি করেছে।”
“যেকোনো ফ্যাসিবাদের লক্ষণ হচ্ছে যে, সে আগে একটা মব বা গোষ্ঠী তৈরি করে” উল্লেখ করে গনসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি বলেন, “তারা নিজেদের কতগুলো গোষ্ঠী তৈরি করে, মনে হয় যেন জনতা একটা জিনিসকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে।”
“এখন বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আমরা ফ্যাসিবাদের পথে যাব নাকি আমরা ডেমোক্রেসির পথে যাবো", বলেন জোনায়েদ সাকি।
জানুয়ারিতে মহাসম্মেলন
‘আমরা এভাবে মারা যেতে চাই না, এইভাবে আমাদের কণ্ঠকে স্তব্ধ করা যাবে না” - উল্লেখ করে শিল্পপতি, গণমাধ্যম উদ্যোক্তা ও নোয়াবের সভাপতি একে আজাদ জানান, আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝিতে একটি সাংবাদিক মহাসম্মেলন করবেন তারা। সেই মহাসম্মেলনের মাধ্যমে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
আর “এটা একদিনের যুদ্ধ না। অনেকদিন এই যুদ্ধ চলবে”, বলেন মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী।