কড়ি থেকে ক্রিপ্টো- মুদ্রার বিবর্তনের ইতিহাস

‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল।’ কথায় কথায় হয়তো আপনিও কখনো ব্যবহার করে ফেলেন এই বাংলা বাগধারাটি। কড়ি একসময় মুদ্রা হিসেবে বাংলায় এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, তার গুরুত্ব এখনও নানাভাবে টিকে আছে প্রবাদ-প্রবচনে। 

কড়ি ছোট্ট এক সামুদ্রিক শামুকের খোল- যার ওজন নেই বললেই চলে। কিন্তু ইতিহাসের কাঁধে তুলে দিয়েছিল এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে ছড়িয়ে পড়া বাণিজ্যের ভার। কড়ি শুধু একটি মুদ্রা নয়, এটি ছিল বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের প্রাচীন সংযোগের জীবন্ত এক প্রতীক।

একটা সময় ছিল- লেনদেন মানেই হাতে কড়ি, থলেতে সোনা-রূপা। রাজাদের সিলমোহর দেওয়া টঙ্কা ছিল সম্পদের প্রতীক, আর বিশ্বাসই ছিল লেনদেনের মূল চালিকা শক্তি। সেই বিশ্বাসের ঠিকানা বদলাতে শুরু করেছে। মুদ্রা এখন চলে যাচ্ছে স্ক্রিনে। কড়ি ঝনঝনানি হারিয়েছে। কাগুজে মুদ্রার স্পর্শও প্রায় হারাতে বসেছে। আর সেখানে জায়গা নিচ্ছে ডিজিটাল লেনদেন এবং অদৃশ্য মুদ্রা- ক্রিপ্টোকারেন্সি।

বিনিময়ের ধারণা যেমন প্রাচীন, তার রূপান্তরও তেমনি বিস্ময়কর। প্রাচীন যুগে মানুষ শস্য, লবণ বা পশু দিয়ে লেনদেন শুরু করেছিল। পরে এল পণ্য মুদ্রা। আর বাংলায় জনপ্রিয় হয়েছিল কড়ি।

সময়ের সঙ্গে সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জের মতো ‘ধাতব মুদ্রা’ লেনদেনে স্থায়ী জায়গা তৈরি করে। রাজকীয় সিলমোহরের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হতো মুদ্রার মান। আর সুলতানি আমলে ছিল রূপার ‘টঙ্কা’। 

ভারী মুদ্রা বহনের ঝামেলা থেকে মুক্তি খুঁজতে সপ্তম শতাব্দীতে চীনে চালু হয় কাগজের মুদ্রা। এরপর নানা বিবর্তন। গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের দাপট চলে প্রায় দুইশো বছর।

বিশ শতকের শেষের দিকে ‘স্বর্ণমান’ ত্যাগ করে বিশ্ব গ্রহণ করে ফিয়াট কারেন্সি, যার মূল্য নির্ভর করে সরকারের ঘোষণা ও জনগণের আস্থার ওপর।

এরপরই শুরু হয় ডিজিটাল ফিন্যান্সের বিপ্লব। ক্রেডিট কার্ড, অনলাইন ব্যাংকিং আর মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বদলে দেয় লেনদেনের ধরণ। কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের সীমাবদ্ধতা থেকে জন্ম নেয় বিকেন্দ্রীভূত এক ধারণা- ক্রিপ্টোকারেন্সি।

বিশ্বমন্দার ভেতর ২০০৮ সালে ব্লকচেইন প্রযুক্তির হাত ধরে আসে বিটকয়েন, যা অর্থনীতির ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।

বাংলাদেশে যদিও ক্রিপ্টোকারেন্সির আইনি ভিত্তি তৈরি হয়নি, তবুও ডিজিটাল লেনদেনে দেশ এখন অনেক এগিয়েছে। বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে- এ যেন টাকার ডিজিটাল রূপান্তরেরই প্রতিচ্ছবি।

কড়ি থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি- এই দীর্ঘ যাত্রা শুধু মুদ্রার বিবর্তনের গল্প নয়, মানব সভ্যতার প্রযুক্তিনির্ভর অগ্রগতিরও এক অনন্য সাক্ষী। 

জটিল সূচনার সমাধানের খোঁজে

মানব ইতিহাসে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের শুরুটা হয়েছিল একেবারে সহজভাবে- বিনিময়ের মাধ্যমে। মানুষ যখন শিকারের জীবন থেকে কৃষিনির্ভর সমাজে প্রবেশ করে, তখনই গড়ে ওঠে প্রাচীনতম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিনিময় প্রথা।

তখন কীভাবে বিনিময় হতো। ধরা যাক- একজন কৃষকের কাছে অতিরিক্ত শস্য আছে এবং একজন শিকারির কাছে আছে পশুর চামড়া। কিন্তু দুজনেরই প্রয়োজন ভিন্ন কিছু। আবার সমাধানও রয়েছে নিজেদের মধ্যেই। একে অপরের সম্পদ নিলেই সমাধান। 

ফলে তারা পণ্য অদলবদল করেই পূরণ করত নিজেদের চাহিদা। প্রয়োজন মেটাতে তারা সরাসরি এই জিনিসগুলো অদলবদল করত।

তখন টাকার ধারণা ছিল না, ছিল শুধু চাহিদা আর বিনিময়। তাই শুরুর দিকে সরাসরি পণ্য বা পরিষেবা বিনিময় করত।

তবে এই ব্যবস্থার বড় সীমাবদ্ধতা ছিল একটাই- দুই পক্ষেরই চাহিদা মিলে যাওয়া। সমাধান কেবল তখনই, যখন চাহিদা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন লেনদেনযোগ্য পণ্য থাকত। একজনের যা দরকার, তা অন্যের কাছে থাকতে হবে। এই নির্ভরশীলতা লেনদেনকে অনেক সময় জটিল ও সময়সাপেক্ষ করে তুলত।

সমস্যার সমাধান মানুষই খুঁজে নেয়। একটি নিরপেক্ষ, সর্বজনগ্রাহ্য বিনিময়ের ধারণার মাধ্যমে- যা হবে টেকসই, সহজে বহনযোগ্য ও মূল্যবান। এর নামই পরে হয় পণ্য মুদ্রা বা কমিউনিটি মানি।

প্রাচীনকালে এই মুদ্রার রূপ ছিল নানা রকম। যেমন- শস্য, লবণ, পশুর চামড়া, শেল বা কড়ি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদান।

প্রাচীন রোমে সৈন্যদের বেতনের অংশ হিসেবে লবণ দেওয়া হতো- ল্যাটিন ভাষা নাম ছিল স্যালারিয়াম। সেখান থেকেই এসেছে আজকের বহুল ব্যবহৃত শব্দ স্যালারি বা বেতন।

সময় যত এগিয়েছে, বিনিময়ের মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করেছে আরও মূল্যবান জিনিস। যেমন- গবাদিপশু, বিভিন্ন ধাতু, এমনকি সোনা ও রূপা। আর এই বিবর্তনের ধারাতেই খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার সালে মেসোপটেমিয়ায় গড়ে ওঠে প্রথম সুশৃঙ্খল বিনিময় কাঠামো।

সেই সময় কৃষকরা তাদের শস্য জমা রাখত মন্দিরে। গচ্ছিত সম্পদ থেকে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা উদ্ভাবন করেছিল তারা। মাটির ফলকে লিপিবদ্ধ হতো সেই হিসাব। আর বিনিময়ে পাওয়া যেত মাটির টোকেন, যা দিয়ে তারা ঋণ পরিশোধ করত।

ইতিহাসবিদদের মতে, এখান থেকেই জন্ম নেয় এক যুগান্তকারী ধারণা- প্রতিনিধি মুদ্রা বা পারসপেকিটভ মানি। বিনিময়ের এই পথচলাই ছিল আধুনিক অর্থব্যবস্থার প্রথম ধাপ। সেখান থেকেই প্রয়োজন, বিশ্বাস আর উদ্ভাবন মিলেই জন্ম দিয়েছে ‘টাকার’ ধারণা।

অর্থনীতিবিদ ডেভিড গ্রেবার 'ডেট: দ্য ফার্স্ট ৫০০০ ইয়ারস' বইয়ে লিখেছেন, মেসোপটেমিয়ায় মন্দিরের প্রশাসকরা রূপা এবং যবের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট মূল্য সম্পর্ক স্থাপন করে প্রথম 'অ্যাকাউন্টের মুদ্রা' তৈরি করেছিলেন।

“যেখানে প্রকৃত লেনদেন যব বা অন্য পণ্যে হতো কিন্তু সব ঋণ রূপায় হিসাব করা হতো।”

ইতিহাসবিদ ক্রিস্টিন ডেসান বলেন, মন্দিরের এই টোকেন ব্যবস্থা শুধু লেনদেনের মাধ্যম নয়, বরং রাষ্ট্রীয় শক্তি এবং জাতীয় সম্পদ নিয়ন্ত্রণের একটি কার্যকর হাতিয়ারও ছিল।

বাংলায় কড়ির রাজত্ব: শামুকের খোল থেকে জন্ম নেওয়া মুদ্রা

বাংলায় কড়ি ছিল তুলনামূলকভাবে দুষ্প্রাপ্য। সাগরপাড়ের অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে আনা হতো মূল্যবান খোল, যা বাজারে দুষ্প্রাপ্যতার কারণে আরও মূল্যবান হয়ে উঠত।

প্রাচীন বাংলার অর্থনৈতিক ইতিহাসে এক সময় রাজত্ব করত এক অদ্ভুত বস্তু- কড়ি। এখন আমরা যাকে কেবল শামুকের খোল হিসেবে দেখি, সেটিই এক সময় ছিল লেনদেন ও সম্পদের প্রতীক।

‘ফেলো কড়ি, মাখো তেল’- এমন বহু প্রবাদ-প্রবচনই প্রমাণ করে, কড়ি একসময় বাংলার দৈনন্দিন জীবনের কতটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল।

গবেষকদের মতে, বাংলায় কড়ির ব্যবহার শুরু হয় মৌর্য যুগে; যখন বাণিজ্য ও কৃষি- উভয় ক্ষেত্রেই নিয়মিত লেনদেনের প্রয়োজন বাড়তে থাকে। 

কড়ি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে মূলত এর কিছু বিশেষ গুণের কারণে। যেমন- সহজে চেনা যেত, টেকসই ছিল, আর দীর্ঘদিনেও এর আকার বা মান নষ্ট হতো না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এটি পরিণত হয় এক আদর্শ বিনিময় মাধ্যমে।

সাধারণভাবে কড়ি বলতে বোঝানো হয় সামুদ্রিক শামুকের খোল। তবে বিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হতো নির্দিষ্ট এক প্রজাতির উজ্জ্বল সাদা শামুক। এটা পাওয়া যেত ভারত মহাসাগরের উষ্ণ জলে, বিশেষ করে মালদ্বীপ ও দক্ষিণ ভারতীয় উপকূলে। এই শামুকের বাইরের শক্ত ও চকচকে খোল কেটে মসৃণ করে বানানো হতো কড়ি।

তবে বাংলায় কড়ি ছিল তুলনামূলকভাবে দুষ্প্রাপ্য। সাগরপাড়ের অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করে আনা হতো মূল্যবান খোল, যা বাজারে দুষ্প্রাপ্যতার কারণে আরও মূল্যবান হয়ে উঠত।

কড়ির আরেকটি বিশেষত্ব ছিল- এর একক আকৃতি ও মাপের সামঞ্জস্য। প্রায় সব কড়িই দেখতে একরকম, ফলে জালিয়াতির সুযোগ ছিল খুব কম।

এই গুণগুলোর কারণেই কড়ি শুধু বাংলায় নয়, প্রাচীন এশিয়া ও আফ্রিকার বহু অঞ্চলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই এক স্বীকৃত মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে বাংলার ক্ষেত্রে কড়ি শুধু লেনদেনের মাধ্যমই ছিল না- এটি ছিল সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক স্থিতির প্রতীকও।

এক সময়ের সেই ছোট্ট সামুদ্রিক শামুকই প্রমাণ করে, মানুষের উদ্ভাবনী শক্তি ও বাণিজ্যবোধ কতটা গভীর ছিল। কড়ি যেন এক অনুচ্চারিত সাক্ষ্য- টাকার ইতিহাসে সাগরের তলদেশ থেকেই শুরু হয়েছিল সভ্যতার অর্থনৈতিক যাত্রা।

আন্তর্জাতিক বিশাল বাণিজ্যের ইতিহাসে ছোট্ট শামুকের খোল

টাকা প্রচলিত হওয়ার বহু আগে মধ্যযুগে এশিয়া থেকে আফ্রিকা জুড়ে লেনদেন হতো কড়ি নামের ছোট সামুদ্রিক শামুকের খোলে।

টাকার রাজত্বের কথা যখন কেউ ভাবতেও পারেনি, তখন ছিল কড়ির সাম্রাজ্য। মধ্যযুগে এশিয়া থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ক্ষুদ্র সামুদ্রিক শামুকের খোলই ছিল লেনদেনের মাধ্যম। প্রাচীন বাংলাও ছিল সেই বৈশ্বিক কড়ি-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র।

বাংলা ও মালদ্বীপের মধ্যে কড়িকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল এক বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ইতিহাস বলে, প্রায় নয়শো বছর ধরে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে মালদ্বীপ থেকে কড়ি আসত বাংলায়। সমুদ্রপথেই এই বাণিজ্য চলত। বাংলা আমদানি করত কড়ি, বিনিময়ে মালদ্বীপের মানুষের জন্য চাল যেত বাংলা থেকে।

চতুর্দশ শতাব্দীর বিখ্যাত মরোক্কান পর্যটক ইবন বতুতা তার ভ্রমণগ্রন্থ রিহলাতে লিখেছেন, মালদ্বীপে তিনি নিজ চোখে দেখেছেন সেখানকার মানুষ সমুদ্র থেকে কড়ি সংগ্রহ করছে এবং বাংলায় রপ্তানি করছে।

পরে পঞ্চদশ শতকের চীনা লেখক মা হুয়ান লিখেছিলেন ইংইয়া শেংলান নামে এক ভ্রমণবৃত্তান্ত। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে, তখন মালদ্বীপ থেকে ভারতে কড়ি রপ্তানি ছিল একটি বড় ব্যবসা।

বাংলার সাহিত্যেও কড়ির অস্তিত্ব স্পষ্ট। বাংলা ভাষার আদি কাব্যসংগ্রহ চর্যাপদেও কড়িকে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ইতিহাসবিদদের মতে, পাল ও সেন যুগ- অর্থাৎ খ্রিষ্টীয় তৃতীয় শতক থেকেই কড়ি এখানে নিয়মিত লেনদেনের অংশ হয়ে ওঠে।

মধ্যযুগের ঐতিহাসিক মিনহাজ-ই-সিরাজ তার তবকাত-ই-নাসিরি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, লক্ষ্মণ সেনের আমলে বাংলায় রূপার মুদ্রা ‘জিতল’-এর পরিবর্তে কড়িই ছিল প্রচলিত বিনিময় মাধ্যম। এমনকি রাজা নিজেও এক লক্ষ কড়ির কমে কোনো দান দিতেন না।

সেই সময় থেকে মুসলিম শাসনকাল পেরিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগের শেষ দিক পর্যন্ত- প্রায় উনিশ শতক জুড়ে বাংলায় কড়ির ব্যবহার অব্যাহত ছিল।

কিন্তু কড়ির কাহিনি শুধু বাংলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা আফ্রিকায় দাস বাণিজ্যে কড়িকেই ব্যবহার করত মুদ্রা হিসেবে। 

মালদ্বীপ থেকে কড়ি রপ্তানি হয়ে পৌঁছাত পশ্চিম আফ্রিকার বাজারে, যেখানে কড়ির বিনিময়ে দাস হিসেবে কেনা হতো মানুষ।

পরে মালদ্বীপের জায়গা নেয় জাঞ্জিবার, যেখান থেকে পশ্চিম আফ্রিকায় ব্যাপক পরিসরে রপ্তানি হতো কড়ি। এমনকি বিশ শতকের শুরুতেও আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে কড়ি ছিল কার্যকর বিনিময় মাধ্যম।

ধাতব মুদ্রা: বিশ্বাস, শক্তি ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক

মানব সভ্যতার অর্থনৈতিক ইতিহাসে ধাতব মুদ্রার আবির্ভাব ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। ধাতুর ব্যবহার শুরু হওয়ার পর মানুষ বুঝতে পারে- তামা, ব্রোঞ্জ, রূপা ও সোনার মতো ধাতু শুধু টেকসই নয়, এগুলোর নিজস্ব মূল্যও রয়েছে।

ফলে ধাতু দ্রুতই পণ্য বিনিময়ের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে জায়গা করে নেয়।

খ্রিষ্টপূর্ব দশম শতাব্দীতে চীনের ঝাউ রাজবংশের সময়ে প্রথম চালু হয় ব্রোঞ্জের মুদ্রা। এর কিছু পরেই, সপ্তম শতকে প্রাচীন গ্রিসে দেখা যায় কচ্ছপের ছাপওয়ালা এক অভিনব মুদ্রা- যা তখনকার রাষ্ট্রীয় প্রতীকের প্রতিফলন।

একই সময়ে বর্তমান তুরস্কের লিডিয়া রাজ্যে রাজা আলিয়াটিস প্রবর্তন করেন বিশ্বের প্রথম মানসম্মত ধাতব মুদ্রা। সেই মুদ্রার এক পিঠে খোদাই করা ছিল গর্জনরত সিংহের চিত্র। ইতিহাসবিদরা বলেন, এই মুদ্রা প্রবর্তনের মাধ্যমে লেনদেনের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে।

ধাতব মুদ্রার মান ও বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করতে শুরু হয় রাজকীয় সিলমোহর ব্যবস্থার প্রবর্তন। মুদ্রার ওজন যাচাইয়ের ঝামেলা দূর হয়, লেনদেন হয় সহজতর, আর একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয় শাসকের সার্বভৌম ক্ষমতা- মুদ্রা হয়ে ওঠে রাজশক্তির প্রতীক।

বাংলায় ধাতব মুদ্রার যুগ

বাংলায় ধাতব মুদ্রার ইতিহাস শুরু হয় সেন বংশের পতনের পর, যখন বখতিয়ার খিলজির আক্রমণের মাধ্যমে মুসলিম শাসনের সূচনা ঘটে। পরবর্তী চারশো বছর জুড়ে সুলতানি থেকে মোগল আমল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল রূপার মুদ্রা- যা পরিচিত ছিল ‘টঙ্কা’ নামে। গবেষকদের মতে, এই টঙ্কা থেকেই টাকা শব্দটির উৎপত্তি।

বাংলায় রূপার কোনো অভ্যন্তরীণ উৎস না থাকায় সুলতানি যুগে রূপা আমদানি করা হতো বর্তমান উত্তর-পূর্ব মিয়ানমার ও চীনের ইউনান প্রদেশের খনি থেকে। একই সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে কড়ির ব্যবহারও তখন চলমান ছিল।

বাংলা জয় করার পর শেরশাহ সুরি প্রচলন করেন নতুন, বিশুদ্ধ ও ভারী রূপার মুদ্রা ‘রূপয়া’- যা পরে সমগ্র উপমহাদেশে মানসম্মত মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। মোগল সম্রাট আকবরের আমলে সোনা, রূপা ও তামার মুদ্রা একসঙ্গে প্রচলিত হলেও, কড়ির ব্যবহার তখনও বন্ধ হয়নি।

মুদ্রার বৈচিত্র্য ও জটিলতা

আঠারো শতকের বাংলায় মুদ্রাব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল। প্রতিটি স্থানীয় শাসকের নিজস্ব মুদ্রা ছিল, যা ছিল তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। 

ফলে তখনকার ভারতজুড়ে প্রচলিত ছিল প্রায় কয়েকশো রকমের মুদ্রা। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলী খাঁয়ের আমলে টাঁকশাল থেকে তৈরি হতো তিন রকম মুদ্রা- সোনা (মোহর), রূপা (টঙ্কা) ও তামা (দাম)।

ব্রিটিশ যুগ ও কড়ির অবসান

উনিশ শতকের আগে পর্যন্তও বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতিতে কড়ি ছিল কার্যকর বিনিময়ের মাধ্যম। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তামার মুদ্রা চালু করে। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মনে করেছিলেন, তামার মুদ্রা চালু হলে কড়িকে পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে।

উনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতির প্রভাবে বাংলায় চালের দাম বেড়ে যায়। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে কড়ির রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। মালদ্বীপ থেকে আমদানিও বন্ধ হয়। অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হয়ে পড়ায় দুই সহস্রাব্দেরও বেশি সময়ের প্রাচীন বিনিময় মাধ্যম কড়ি চলে যায় ইতিহাসের পাতায়।

এরপর থেকে বাংলার সমস্ত অর্থনৈতিক লেনদেন সম্পূর্ণরূপে চলে আসে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে। কড়ির জায়গা নেয় ধাতব মুদ্রা- যা শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক আধিপত্যেরও প্রতীক হয়ে ওঠে।

কাগজের মুদ্রা: বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি ও অর্থনীতির নতুন যুগের সূচনা

ধাতব মুদ্রার ঝক্কি সামলাতে সপ্তম শতকে চীনে জন্ম নেয় কাগজের মুদ্রার ধারণা, ‘ফ্লাইং মানি’র মাধ্যমে সহজ হয় দূর-দূরান্তের বাণিজ্য। এই প্রমিসরি নোটই পরবর্তীতে আধুনিক কাগুজে টাকার পথ খুলে দেয়।

ধাতব মুদ্রার যুগে বাণিজ্যিক লেনদেন যখন আরও বিস্তৃত হতে শুরু করল, তখনই জন্ম নিল অর্থনীতির এক নতুন অধ্যায়- কাগজের মুদ্রা। তবে এই ধারণার সূত্রপাত চীনে হয়েছিল অনেক আগেই, প্রায় খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে।

সেই সময়ের ব্যবসায়ীরা পণ্য বিক্রির জন্য দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করতেন। ভারী ধাতব মুদ্রা সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করা ছিল কষ্টকর ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ সমস্যার সমাধানেই তারা ব্যবহার করতে শুরু করেন এক ধরনের কাগজের প্রমাণপত্র- যা ছিল মূলত ‘ফ্লাইং মানি’ বা প্রমিসরি নোট।

এগুলোর মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে সমমূল্যের ধাতব মুদ্রা তুলে নেওয়া যেত। ইতিহাসবিদদের মতে, এই ব্যবস্থা প্রথম চালু হয় চীনের ট্যাং রাজবংশের সময়ে, যা পরবর্তীতে মুদ্রার ধারণাকেই বদলে দেয়।

ইউরোপে স্বর্ণকারদের রসিদ থেকে ব্যাংকনোট

ইউরোপে কাগজের মুদ্রার সূচনা হয় এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। মধ্যযুগে মানুষ তাদের সোনা ও মূল্যবান ধাতু স্বর্ণকারদের কাছে জমা রাখত। আর বিনিময়ে পেত একটি রসিদ বা প্রাপ্তিপত্র। ধীরে ধীরে এই রসিদগুলোই লেনদেনের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে- কারণ মানুষ বিশ্বাস করত, যেকোনো সময় সেই রসিদ দেখিয়ে তারা সোনা ফেরত পাবে। এভাবেই তৈরি হয় প্রতিনিধিত্বমূলক মুদ্রার ধারণা।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই ধারণাই রূপ নেয় বৈশ্বিক অর্থনীতির মানদণ্ডে- গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড বা স্বর্ণমান হিসেবে। তখন প্রতিটি কাগজের নোটের বিপরীতে নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা রিজার্ভ রাখত কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা মানুষের আস্থার মূলভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।

ফিয়াট কারেন্সির যুগে প্রবেশ

বিংশ শতাব্দীতে এসে বিশ্ব অর্থনীতি এক বড় মোড় নেয়। ১৯৩০ সালের মহামন্দা ও ১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের স্বর্ণমান বাতিলের সিদ্ধান্ত স্বর্ণনির্ভর অর্থব্যবস্থার অবসান ঘটায়। তখন থেকেই বিশ্বের অধিকাংশ দেশ গ্রহণ করে নতুন এক মুদ্রা ব্যবস্থা- ফিয়াট কারেন্সি।

ফিয়াট মুদ্রার নিজস্ব কোনো অভ্যন্তরীণ মূল্য নেই। এর শক্তি আসে কেবল সরকারি ঘোষণা ও জনগণের বিশ্বাস থেকে। সরকার এটিকে আইনত টেন্ডার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, অর্থাৎ ঋণ ও লেনদেনের ক্ষেত্রে এটি বাধ্যতামূলক। তখন থেকে টাকার মূল্য আর সোনায় নয়, নির্ভর করে বিশ্বাসে।

উপমহাদেশে কাগজের মুদ্রা

উপমহাদেশে প্রথম কাগজের মুদ্রা চালু হয় ১৮৫৭ সালে, ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং-এর সময়। এটি ছিল ব্রিটিশ রাজের নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। পরবর্তীতে ১৯৬১ সালে চালু হয় দশমিক মুদ্রা ব্যবস্থা, যা আধুনিক আর্থিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করে।

বাংলাদেশে টাকার জন্ম

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে চালু হয় টাকা, যা নতুন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেই বছরই বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন নোট ও কয়েন ইস্যু করে। আজও দেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে এই কাগুজে নোট ও কয়েন।

ধাতব মুদ্রার ঝনঝনানি থেকে শুরু করে কাগজের মুদ্রার নরম স্পর্শ- এই রূপান্তর শুধু প্রযুক্তি বা বাণিজ্যের গল্প নয়; এটি মানুষের বিশ্বাস, প্রতিশ্রুতি ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার এক ঐতিহাসিক যাত্রা। কড়ি, টঙ্কা, রূপয়া পেরিয়ে টাকার গল্প আজও চলছে- বিশ্বাসের কাগুজে প্রতীক হয়ে।

ডিজিটাল যুগের সূচনা ও ক্রিপ্টোকারেন্সির উত্থান: অর্থনীতির অদৃশ্য বিপ্লব

২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময় জন্ম নেয় বিকেন্দ্রীভূত ডিজিটাল মুদ্রা ক্রিপ্টোকারেন্সি। সাতোশি নাকামোতো নামের এক ব্যক্তি পিয়ার-টু-পিয়ার লেনদেনের জন্য বিটকয়েন চালু করেন।

ফিয়াট কারেন্সির স্থিতিশীল যুগেও নীরবে জন্ম নিচ্ছিল এক নতুন আর্থিক বিপ্লব- ডিজিটাল ফিন্যান্সের যুগ। অর্থনীতির এই অধ্যায়ে কাগজের নোটের জায়গা নিতে শুরু করল কোড, নেটওয়ার্ক আর ভার্চুয়াল লেনদেনের জগৎ।

ক্রেডিট কার্ডের আবির্ভাব

১৯৫০-এর দশকে আমেরিকায় প্রথম ক্রেডিট কার্ড চালু হয়। তখন সেটিই ছিল আধুনিক ডিজিটাল অর্থনীতির সূচনা। এটি মানুষকে হাতে নগদ টাকা ছাড়াই তাৎক্ষণিক কেনাকাটার সুযোগ দেয়। অর্থাৎ, টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতিও হয়ে ওঠে এক ধরনের মুদ্রা।

এর পরবর্তী ধাপে আসে ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার (EFT), যা ব্যাংকগুলোকে এক দেশ থেকে আরেক দেশে মুহূর্তের মধ্যে অর্থ পাঠানোর সুযোগ দেয়। ধীরে ধীরে নগদ টাকার উপর নির্ভরতা কমতে শুরু করে।

ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও ভার্চুয়াল লেনদেনের যুগ

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে ইন্টারনেটের বিস্ফোরণ অর্থনীতিকে একেবারে নতুন আঙ্গিকে রূপ দেয়। অনলাইন ব্যাংকিং, পেমেন্ট গেটওয়ে, ই-কমার্স- এসব প্রযুক্তি লেনদেনকে আরও দ্রুত, সহজ এবং অদৃশ্য করে তোলে। টাকার হাতবদল আর পকেটে নয়, ঘটতে থাকে স্ক্রিনে বা ক্লাউডে।

তবে এই ডিজিটাল লেনদেন তখনও ফিয়াট মুদ্রার ভিত্তিতেই পরিচালিত, যার নিয়ন্ত্রণ থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের হাতে।

বিশ্বাসের সংকট থেকে জন্ম ক্রিপ্টোকারেন্সির

একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, বিশেষ করে ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা নড়ে যায়। এই বিশ্বাসের ফাঁক থেকেই জন্ম নেয় এক বৈপ্লবিক ধারণা- বিকেন্দ্রীভূত ডিজিটাল মুদ্রা, বা ক্রিপ্টোকারেন্সি।

সেই বছরই ‘সাতোশি নাকামোতো’ নামের এক রহস্যময় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রকাশ করেন এক প্রযুক্তিগত বিপ্লব- বিটকয়েন। এটি ছিল এমন এক পিয়ার-টু-পিয়ার ইলেকট্রনিক ক্যাশ সিস্টেম, যেখানে ব্যাংক বা সরকারের মতো কোনো মধ্যস্থতাকারী ছাড়াই সরাসরি লেনদেন করা সম্ভব।

ব্লকচেইন: ক্রিপ্টোগ্রাফির অটল দেয়াল

ক্রিপ্টোকারেন্সির ভিত্তি গড়ে উঠেছে ব্লকচেইন প্রযুক্তির উপর, যা মূলত এক ধরনের স্বচ্ছ ও অপরিবর্তনীয় ডাটাবেজ। প্রতিটি লেনদেন সেখানে একটি ‘ব্লক’ হিসেবে যুক্ত হয় এবং ক্রিপ্টোগ্রাফি বা গুপ্ত লিখন পদ্ধতির মাধ্যমে সুরক্ষিত থাকে। একবার কোনো তথ্য সেখানে সংরক্ষিত হলে তা আর পরিবর্তন করা যায় না- ফলে প্রতারণা বা জালিয়াতির সুযোগ থাকে না।

ঐতিহ্যবাহী মুদ্রা যেখানে সরকারের ওপর বিশ্বাসের ভিত্তিতে চলে সেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি চলে গণিত ও কোডিংয়ের নির্ভুলতার উপর। এটি এক এমন অর্থনৈতিক কাঠামো, যেখানে বিশ্বাসের জায়গা নেয় প্রযুক্তি।

বিটকয়েন থেকে ইথেরিয়াম: এক নতুন ডিজিটাল ইকোসিস্টেম

বিটকয়েনের অভূতপূর্ব সাফল্যের পর ক্রিপ্টো দুনিয়ায় দেখা যায় এক বিস্ফোরণ। জন্ম নেয় হাজার হাজার নতুন ডিজিটাল মুদ্রা- ইথেরিয়াম, সোলানা, রিপলসহ আরও অসংখ্য টোকেন।

বিশেষ করে ইথেরিয়াম ব্লকচেইনকে নিয়ে যায় এক নতুন উচ্চতায়- এখানে মুদ্রা শুধু বিনিময়ের মাধ্যম নয়, বরং এটি ব্যবহার হয় স্মার্ট কনট্রাক্ট এবং বিকেন্দ্রীভূত অ্যাপ্লিকেশন (DApps) তৈরিতে। এই ধারণাই গড়ে তুলেছে এক সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার নাম ‘বিকেন্দ্রীভূত অর্থায়ন’ বা DeFi (Decentralized Finance)।

কাগজের টাকা থেকে কোডের মুদ্রা- মানব সভ্যতার এই অভিযাত্রা শুধু অর্থের বিবর্তন নয়, এটি বিশ্বাসের বিবর্তনও। যেখানে একসময় বিশ্বাস রাখা হতো সোনায়, তারপর সরকারে; আজ সেই বিশ্বাস স্থান করে নিয়েছে প্রযুক্তি ও অ্যালগরিদমে।

অর্থনীতি তাই আজ আগের চেয়ে অনেক বেশি অদৃশ্য, বিকেন্দ্রীভূত, কিন্তু আরও গতিশীল ও বৈশ্বিক। চোখে দেখা যায় না, হাতে ধরা যায় না- তবুও এই ডিজিটাল মুদ্রাই এখন বিশ্ব অর্থনীতির পরবর্তী অধ্যায়ের লেখক।

বিবর্তনের পরবর্তী অধ্যায়

বিশ শতকের শেষ ভাগে, যখন পৃথিবী ডিজিটাল বিপ্লবের পথে পা বাড়ায়, তখন অর্থের ধারণাও পালটাতে শুরু করে। লেনদেন আর শুধু হাতে ধরা কাগজ বা ধাতব মুদ্রায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি ছড়িয়ে পড়ে মোবাইল স্ক্রিনে, ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে, এবং ভার্চুয়াল ব্যালান্সে।

মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল পেমেন্ট প্লাটফর্ম অর্থনীতিকে করে তুলেছে আরও দ্রুত, সহজ ও সাশ্রয়ী। বাংলাদেশেও এই রূপান্তর চোখে পড়ার মতো।

বিকাশ, নগদ, উপায় কিংবা অন্যান্য মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিস এখন লাখো মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। গ্রামের চায়ের দোকান থেকে শুরু করে শহরের বড় ব্যবসা পর্যন্ত- সব জায়গাতেই চলছে ইন্টারনেট লেনদেনের বিপ্লব।

তবে এই পুরো ব্যবস্থা এখনো প্রথাগত ফিয়াট কারেন্সিনির্ভর। মানে- লেনদেনগুলো শেষ পর্যন্ত টাকার রূপেই নিষ্পত্তি হয়, ডিজিটাল প্লাটফর্ম কেবল মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

ক্রিপ্টোকারেন্সির জটিল বাস্তবতা

বিশ্বজুড়ে যখন ক্রিপ্টোকারেন্সি নিয়ে উন্মাদনা চলছে, তখন বাংলাদেশ এখনো সতর্ক অবস্থানে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক বিটকয়েনসহ ভার্চুয়াল মুদ্রা লেনদেনের বিষয়ে সতর্কতা জারি করে। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়- এই ধরনের মুদ্রা কোনো দেশের বৈধ কর্তৃপক্ষ ইস্যু করে না। ফলে এর বিপরীতে আর্থিক দাবির কোনো স্বীকৃতি নেই।

এর পেছনে যুক্তিও যথেষ্ট দৃঢ়। ক্রিপ্টোকারেন্সির মূল্যের অস্থিরতা, নিয়ন্ত্রণহীনতা এবং জালিয়াতির ঝুঁকি অনেক দেশকেই এখনো দ্বিধায় রেখেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়।

তবে সময় থেমে নেই। ২০২২ সালে সরকার দেশের প্রথম ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, যা ভবিষ্যতের অর্থব্যবস্থার দিকে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। প্রক্রিয়াটি এখনো চলমান, ১২টি প্রতিষ্ঠান আবেদন করেছে। তবে এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে- দেশ ধীরে ধীরে এক নতুন যুগে প্রবেশের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিতর্ক: ভবিষ্যৎ না পতন?

বিশেষজ্ঞরা ক্রিপ্টোকারেন্সির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভক্ত। কেউ মনে করেন, অর্থের পরবর্তী বিবর্তন হিসেবে এটি আগামীদিনের বৈশ্বিক মুদ্রা ব্যবস্থার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠবে। অন্যদিকে, অনেকে একে দেখছেন এক ‘অস্থির বুদবুদ’ হিসেবে, যার পতন অনিবার্য।

নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ইউজিন এফ. ফামা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আগামী দশকের মধ্যেই বিটকয়েনের বাজারমূল্য শূন্যে নেমে যেতে পারে। তার যুক্তি, একটি মুদ্রা দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকতে হলে তার মূল্য স্থিতিশীল হতে হয়। কিন্তু বিটকয়েনের অস্থির দাম সেটিকে কার্যকর বিনিময় মাধ্যম হতে দিচ্ছে না।

অবিরাম অভিযাত্রা

মানব সভ্যতার বিনিময় ইতিহাসে এক অদ্ভুত ধারাবাহিকতা আছে। প্রাচীন বাংলার কড়ি যেমন তার যুগে এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল, তেমনি আজকের ক্রিপ্টোকারেন্সিও এক নতুন অর্থনৈতিক যুগের সূচনা করছে। পার্থক্য শুধু মাধ্যমের- উদ্দেশ্য একই; সহজ, বিশ্বাসযোগ্য এবং সার্বজনীন লেনদেনের সন্ধান।

আগামীর দিকনির্দেশনা

ভবিষ্যতের মুদ্রা ব্যবস্থা সম্ভবত হবে একটি সংকর রূপ- যেখানে ঐতিহ্যবাহী ফিয়াট কারেন্সি, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রা এবং বিকেন্দ্রীভূত ক্রিপ্টোকারেন্সি একসঙ্গে অবস্থান করবে। এই সমন্বয়ই হয়ত গড়ে তুলবে এমন এক আর্থিক কাঠামো, যেখানে নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা দুটোই থাকবে ভারসাম্যে।

তবে এই পথে এগোতে হলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের দরকার সুস্পষ্ট নীতিনির্ধারণ, প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধি। কারণ, অর্থের এই রূপান্তর শুধু লেনদেনের নয়- এটি রাষ্ট্র, অর্থনীতি, এমনকি বিশ্বাসের কাঠামোকেও নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে।

মানবসভ্যতার বিনিময় প্রথা কড়ির দিন থেকে এখন পর্যন্ত এক অবিরাম যাত্রার ভেতর দিয়ে চলছে। হয়ত আগামীদিনে অর্থের কোনো শারীরিক অস্তিত্বই থাকবে না- থাকবে শুধু কোড, ব্লকচেইন আর বিশ্বাসের ডিজিটাল নকশা।

তবুও ইতিহাস শিক্ষা দেয়- অর্থের রূপ বদলায়, কিন্তু বিনিময়ের প্রয়োজন কখনো হারায় না। কড়ির প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে ক্রিপ্টোর ভবিষ্যৎ- এটাই মানব অর্থনীতির নিরন্তর বিবর্তনের গল্প।